ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ১১:০৫ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৬৪ বার
শস্য শ্যামলা ও সুজলা-সুফলা আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ দান। বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হয়। ষড়ঋতুর এ দেশের পরিবেশ ও প্রকৃতি প্রতি বছর ছয়বার ভিন্ন ভিন্ন সাজসজ্জার রূপ ধারণ করে। বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও আপাতত বাস্তবে দু’টি ঋতু লক্ষ্য করা হয়। শীত ও গ্রীষ্মকাল। পবিত্র কুরআন মাজিদেও আল্লাহ তায়ালা শুধু দুটো ঋতুর কথা উল্লেখ করেছেন। তা হলো- শীত ও গ্রীষ্মকাল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের (কুরাইশ বংশের লোকদের) অভ্যাস ছিল শীত ও গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণ’ (সূরা আল-কুরাইশ-০২)।
শীতকালে আমরা মাত্রাতিরিক্ত ঠাণ্ডার মুখোমুখি হই। অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে আমরা প্রচুর গরম ও তাপ অনুভব করি। এই দুই ঋতুতে ঠাণ্ডা ও গরমের প্রখরতা মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে। হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘জাহান্নাম তার প্রতিপালকের কাছে এই বলে অভিযোগ করেছিল যে, হে আমার প্রতিপালক! (প্রচণ্ড উত্তাপের কারণে) আমার এক অংশ অন্য অংশকে গ্রাস করে ফেলেছে। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে দু’টি শ্বাস ফেলার অনুমতি দিলেন। একটি শীতকালে, অপরটি গ্রীষ্মকালে। আর সে দুটি হলো- তোমরা গ্রীষ্মকালে যে প্রচণ্ড উত্তাপ ও শীতকালে যে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব করো তাই’ (সহিহ বুখারি)। অন্য একটি হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, রাসূলে কারিম সা: ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা গরমের যে প্রচণ্ডতা অনুভব করো তা জাহান্নামের গরম নিঃশ্বাসের কারণেই। আর শীতের তীব্রতা যা পাও তা জাহান্নামের ঠাণ্ডা নিঃশ্বাসের কারণেই’ (সহিহ বুখারি)।
তবে হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: শীতকালকে মুমিনের জন্য ঋতুরাজ বসন্ত বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘শীতকাল হলো মুমিনের বসন্তকাল’ (মুসনাদে আহমাদ)। এর মানে হলো, মুমিন বান্দার অফুরন্ত ইবাদতের জন্য শীতকাল হলো সবচেয়ে উত্তম সময়। শীতকাল মুমিনের জন্য রহমতস্বরূপ। আরো প্রখ্যাত সাহাবি ও মনীষীরা শীতকালকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক রা: বলেন, ‘শীতকাল হলো মুমিনের জন্য গনিমত’।
শীতকাল শুধু আমলের মাস নয়; বরং শীতকালে নানান রকম শাকসবজি ও ফলমূল খুব ভালো ফলন হয়। আর তখন খুব কম দামেই এগুলো পাওয়া যায়। এটিও আমাদের প্রতি মহান রবের অপার কৃপা।
শীতকালের দিনগুলো ছোট ছোট থাকে এবং পানির পিপাসা কম হয়। তাই আমরা ইচ্ছে করলে এই সময়ে কম কষ্টে বেশি বেশি নফল সিয়াম (রোজা) পালন করতে পারি। নবী সা: বলেন, শীতকালের সিয়াম হলো অনায়াসলব্ধ গনিমত সম্পদের মতো। অর্থাৎ যে সম্পদ অর্জিত হয় খুব অনায়াসে। এ জন্য আমরা এই শীতকালে অল্প কিছু হলেও নফল সিয়াম পালনের চেষ্টা করি। সোম ও বৃহস্পতিবারের সাপ্তাহিক সিয়াম পালন করি। আইয়ামে বিজের (হিজরি মাসের ১৩, ১৪, ১৫) দিনগুলোতে সিয়াম পালন করি। এ ছাড়া যদি কারো রমজানের সিয়ামের কাজা থেকে থাকে, তাহলে সেই কাজাগুলো এখন আদায় করে ফেলতে পারি। সিয়াম পালন করার সর্বোত্তম সময় হলো শীতকাল। এই বিষয়ে ইমাম গাজ্জালি রাহ: বলেন, ‘আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্য শীতকালের চেয়ে প্রিয় কোনো সময় আছে কি-না আমার জানা নেই। কারণ শীতের দিনগুলো ছোট থাকে আর রাতগুলো বড় হয়। তাই দিনে রোজা রাখা আর রাতে সালাতে দাঁড়িয়ে থাকা সহজ হয়’ (কিমিয়ায়ে সাআদাত)।
শীতকালে দিনগুলো ছোট হলেও রাতগুলো অনেক বেশি দীর্ঘ হয়। তাই রাত ১০-১১টার মধ্যে শুয়ে পড়লে অনেক লম্বা সময় তৃপ্তিসহ ঘুমিয়েও ফজরের আগে উঠা সহজ হয়। এই বড় রাত্রির সুযোগ আমরা সহজেই কাজে লাগাতে পারি নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে। তাহাজ্জুদ সালাত নফল হলেও সরাসরি আল্লাহ তায়ালা কুরআনে তাহাজ্জুদ সালাতের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। তাহাজ্জুদ সালাত বান্দাকে সম্মানিত করে বলেও আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন। একটি হাদিসের ভাষ্য এমন- যেই লোক কনকনে শীতের মধ্যে অজু করে সালাত আদায় করবে আল্লাহ তায়ালা তার দিকে তাকিয়ে হেসে দেন। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় অনেক উলামায়ে কেরাম বলেছেন, তাহাজ্জুদের সালাত আবার অনেকে বলেছেন ফজরের সালাত। অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে, আল্লাহ তায়ালা ওই বান্দার দিকে তাকিয়ে হেসে দেবেন এবং তাকে তিনি মাফ করে দিয়ে জান্নাত দান করবেন। শীতকাল এলে আল্লাহর রাসূল সা:-এর প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলতেন, ‘শীতকালকে স্বাগতম। কেননা তা বরকত নিয়ে আসে। শীতের সময় রাত লম্বা হয়, যা কিয়ামুল লাইলের (তাহাজ্জুদ সালাতের) জন্য সহায়ক এবং দিনগুলো ছোট হয়, যাতে রোজা রাখতে সহজ হয়।’
শীতকালে আরেকটি কষ্টের কাজ হলো ফজর ও এশার সময় অজু করা। তখন ঠাণ্ডা থাকে, তাই অনেকেই এই সালাতের সময় অজু করতে ভয় পান। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সা: আমাদের জন্য বিশাল এক সুসংবাদ দিয়েছেন শীতকালে অজুর বিষয়ে!
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন বিষয়ের সংবাদ দেবো না, যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের গোনাহসমূহ মুছে দেবেন এবং তোমাদের সম্মান বৃদ্ধি করবেন?’ তখন সাহাবায়ে কেরাম বললেন, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল! তখন রাসূলুল্লাহ সা: বলেন ‘শীত বা অন্য কোনো কষ্টের সময়ে ভালোভাবে অজু করা।’ তাই শীতকালে আমাদের উচিত কষ্ট করে অজু চেপে না রেখে প্রয়োজন অনুযায়ী অজু করা। অনেকেই আমরা আছি, যারা আসরের অজু দিয়ে এশার সালাত আদায় করার চেষ্টা করেন। এর উদ্দেশ্যে দরকার থাকলেও পানি পান করা হয় না এবং টয়লেটও চেপে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটি স্বাস্থ্যের জন্য যেমন চরম পর্যায়ের ক্ষতিকর, একইভাবে সালাতের মনোযোগ নষ্ট হওয়ার জন্যও দায়ী। পেশাব-পায়খানা বা বায়ুর চাপ নিয়ে সালাত আদায় করা অনুচিত। এতে সালাতের মনোযোগ ও বিনয় বিনষ্ট হয়।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তা ছাড়া করোনা নামক মহামারী আমাদের দেশের অনেক ধনী মানুষকে রাস্তায় ফকির বানিয়ে ছেড়েছে। এমনও অনেক মানুষ আছে যারা নিয়মিত নিজেদের তিন বেলা খাবারই জুটাতে পারে না আর সেখানে শীতকালে শীতের পোশাক কেনার চিন্তা করা তো বিলাসিতা। তাই আমাদের দেশের বহু মানুষ শীতকালে শীতে কষ্ট পান। শীতে তারা একরকম পিষ্ট হয়ে যান। তাই আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে সামর্থ্য দিয়েছেন তাদের উচিত শীতার্ত মানুষকে শীতবস্ত্র দেয়ার চেষ্টা করা এবং শীতে যারা কষ্টে ভোগেন এ মানুষগুলোর কল্যাণে কাজ করা। এটি বিশাল মানবিক কাজ। শীতার্ত মানুষকে শীতবস্ত্র দেয়া শুধু মানবিক কাজই নয়; বরং এটি ইসলামের নির্দেশনাও বটে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সে, যে কি না মানুষের জন্য কল্যাণের কাজে আসে বা মানুষের উপকার করে।’ আর শীতের সময়ে একজন শীতার্ত মানুষকে শীতের কাপড় দেয়া অনেক বড় উপকারের কাজ। শীতকালে শীতার্ত মানুষকে শীতের বস্ত্র উপহার দেয়া কত বড় উপকারের কাজ যার শীতবস্ত্র নেই সে ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। এর মাধ্যমে শীতার্ত মানুষ খুশি হয়ে যায় আর আমরা খুব সহজেই আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে উঠতে পারি। যার অনেক সামর্থ্য আছে তিনি সাধ্যমতো বেশি খরচ করতে পারেন। যার একেবারেই কম সামর্থ্য তিনি ২০-৫০ টাকা খরচ করে একটি মাফলার বা এরকম ছোট কিছু হলেও দান করি। যার উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন।
আসুন আমরা শীতের সময় ও সুযোগগুলো সুন্দরভাবে কাজে লাগাই। শীতকালে আমরা যেন বিশেষভাবে কিছু আমলের মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি।