ঢাকা, শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

রক্কোর মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতার চোখে বাংলাদেশ

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৩:৪৯ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৭৫ বার


রক্কোর মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতার চোখে বাংলাদেশ

বিশ্বখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা। বিশ্বব্যাপী ইবনে বতুতা নামে পরিচিত হলেও তার মূল নাম শেখ আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ। উত্তর আফ্রিকার মরক্কোর তাঞ্জিয়ারে ১৩০৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে একজন পর্যটক, বিচারক, চিন্তাবিদ ও ধর্মতাত্ত্বিক।

ইবনে বতুতার বিশ্বভ্রমণ
ইবনে বতুতা ২০ বছর বয়সে বেরিয়ে পড়েন বিশ্বভ্রমণে। এরপর একটানা ৩০ বছর ঘুরে বেড়ান বিশ্বের নানা প্রান্ত। এ সময় তিনি ভ্রমণ করেন ১,২০,০০০ কিলোমিটার। তিনি যে সব জায়গায় সফর করেছিল তা বেশিভাগই মুসলিম অধ্যুষিত ছিল।

ইবনে বতুতা 'আর রিহলা' নামক গ্রন্থে তার ভ্রমণকাহিনীগুলো লিপিবদ্ধ করেন। ভ্রমণপরম্পরায় বাংলাদেশেও এসেছিলেন। যার বিবরণ উঠে এসেছে ইবনে বতুতা তার 'আর রিহলা' গ্রন্থে। 

দক্ষিণ ভারত থেকে চট্টগ্রামে ইবনে বতুতা
ইবনে বতুতা তার 'আর রিহলা' গ্রন্থে বলেছেন, দক্ষিণ ভারত থেকে ৪৩ দিন সাগর ভ্রমণ শেষে বাঙ্গালা (বাংলা) দেশের সদকাওয়ান (চট্টগ্রাম) নামক জায়গায় পৌঁছান তিনি। তার গ্রন্থ 'আর রিহলা'র মতে বিশেষজ্ঞরা সদকাওয়ান জায়গাটিকে চট্টগ্রাম বলে উল্লেখ করেছেন। তখন বাংলা অঞ্চলের স্বাধীন শাসক ছিলেন ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ (শাসনকাল ১৩৩৮-১৩৪৯)। এর রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। 

বাংলা অঞ্চল নিয়ে ইবনে বতুতার মন্তব্য
ইবনে বাতুতা তৎকালীন বাংলা অঞ্চল দেখে বলেন, ‘এ বিশাল দেশে প্রচুর চাল উৎপন্ন হয়। সারা পৃথিবীতে আমি এমন কোনো দেশ দেখিনি যেখানে জিনিসপত্রের মূল্য বাংলার চেয়ে কম। পক্ষান্তরে এ একটি অন্ধকার দেশ। খোরাসানের লোকেরা বলে, বাংলা ভাল জিনিসে পরিপূর্ণ একটি নরক (A Hell Full Of Good Things)।’

ইবনে বতুতা জানান, 'এক দেরহামে আটটি মোটাতাজা মুরগি, দুই দেরহামে একটি মোটাতাজা ভেড়া এখানে বিক্রি হতে আমি দেখেছি। তাছাড়া ত্রিশ হাত লম্বা উৎকৃষ্ট ধরনের সূতী কাপড় মাত্র দুই দিনারে এখানে বিক্রি হতে দেখেছি। এক স্বর্ণ দিনারে অর্থাৎ মরক্কোর আড়াই স্বর্ণ দিনারে এখানে সুন্দরী ত্রুীতদাসী বালিকা বিক্রি হয়। সমুদ্রোপকুলে আমরা যে বৃহৎ শহরে প্রবেশ করি তার নাম সাদকাওয়ান।’

যে কারণে বাংলাদেশে এসেছিলেন ইবনে বতুতা
ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেকালের আধ্যাত্মিক সম্রাট সিলেটের হজরত শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.)-এর সান্নিধ্য লাভ। ইবনে বতুতা সিলেটের নাম বলেছেন ‘কামরু পাহাড়’। ইবনে বতুতা বর্ণনা করেন, আমি ‘সোদকাওয়ান’ ত্যাগ করে কামরু (কামরূপ) পর্বতমালার দিকে রওনা হলাম। ওই পর্বতমালাতে আমার যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল একজন দরবেশকে দর্শন করা।

শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.) বাসস্থান থেকে দুইদিনের পথ দূরে থাকতেই ইবনে বতুতা সঙ্গে শায়েখের দুইজন শিষ্যের দেখা হয়। শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.) তার শিষ্যদের ইবনে বতুতাকে অভর্থনা জানানোর জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ইবনে বতুতা তার সম্পর্কে কোনো কিছুই শাহজালাল (রহ.)-কে আগে থেকে জ্ঞাত করেননি। তবুও শাহজালাল (রহ.) তার ব্যাপারে অবগত ছিলেন। এ থেকেই ইবনে বতুতার শায়েখের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার ব্যাপারে ইঙ্গিত পান।

শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.)-এর সান্নিধ্যে ইবনে বতুতা
ইবনে বাতুতা বলেন, ‘আমি যখন শায়খের সম্মুখে উপস্থিত হই, তিনি দাঁড়িয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানান। বুকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি আমার দেশ কোথায় এবং সফরের উদ্দেশ্য কী জানতে চান। অতঃপর তিনি আমাকে সসম্মানে আপ্যায়নের জন্য তাদের নির্দেশ দেন।’

শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.) সম্পর্কে ইবনে বতুতার মন্তব্য
ইবনে বতুতা আরো বলেন, এ শায়খের শ্রমের ফলে ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা ইসলামে দীক্ষিত হয়। এ জন্য তিনি তাদের মধ্যে বসতি স্থাপন করেন। সেখানের এক পর্বত কন্দরে তিনি ‘খানকাহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই খানকাহ ছিল সাধু, দরবেশ, পরিব্রাজক ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করত।
তার জন্য খাদ্যদ্রব্যসহ নানা সামগ্রী উপহার আনত। এসব উপহারসামগ্রী দিয়ে তার আস্তানায় বহু লোককে খাওয়ানো হতো। তার অনুসারীরা পরবর্তী সময়ে ইবনে বতুতাকে জানান যে, এ দরবেশ ১৫০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। 

সিলেট থেকে তৎকালীন বাঙলার রাজধানীতে ইবনে বতুতা
ইবনে বতুতা শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.)-এর কাছে তিনদিনের আতিথ্যে ছিলেন। তার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ইবনে বতুতা আন-নহর উল-আজরাক (মেঘনা নদী) মধ্যে পনেরো দিনের পথ পাড়ি দিয়ে সোনারকাওয়ানে (সোনারগাঁও) পৌঁছান। এই পনেরো দিনের নদী পথের যাত্রায় বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে মনোমুগ্ধকর করে তুলেছিল। তার এই যাত্রাপথে নদীর দুইধারে ফলের বাগান ও গ্রামাগুলো দেখতে পেয়েছিল, যা তিনি বাজারের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার তুলনা করেছেন। 

বাঙলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ ইবনে বতুতা
অসংখ্য নৌকা এই নদীপথে যাত্রা করতো, কিন্তু যখন একটি নৌকা অপর নৌকার সঙ্গে দেখা হতো তখন উভয়ে নিজেদের ঢাক পিটিয়ে অভিবাদন জানাত। সুলতান ফখরউদ্দীন সুফি দরবেশদের চলাচলের জন্য এই নদীতে কোনো ধরণের কর নিতেন না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ফলজ উপাদান এবং অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে আন-নহর উল-আজরাক অর্থাৎ মেঘনা নদীকে তিনি মিশরের নীল নদের সাথে তুলনা করেছিলেন।

সূত্র : (এইচ এ আর গীব ইবনে বতুতা, অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, ড. এনামুল হক, বঙ্গে সুফি প্রভাব, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য অবলম্বনে)


   আরও সংবাদ