ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাতে মুমিনের করণীয়

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৫ মে, ২০২৩ ০৯:১০ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫২৩ বার


ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাতে মুমিনের করণীয়

বাতাস ও বৃষ্টি মহান আল্লাহর অফুরন্ত রহমত। বৃষ্টি হলে পৃথিবী সজীব ও সতেজ হয়। প্রাণিকুল যেন প্রাণের ছোঁয়ায় উচ্ছলিত হয়ে ওঠে। আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমেই আল্লাহ সৃষ্টিজীবের কল্যাণ ও রিজিকের ব্যবস্থা করেন। তবে ঝড়-তুফান ও প্রবল বৃষ্টি মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার সৃষ্টি করে। কৃষকের মুখে ছড়িয়ে পড়ে বিষাদের ছায়া। আসলে বাতাস, ঝড়, বৃষ্টি এসব একই সঙ্গে মহান আল্লাহর রহমত এবং আজাবের শাস্তিও বটে। মূলত আল্লাহর হুকুম ছাড়া বৃষ্টি বর্ষিত হয় না। আবার আল্লাহর হুকুম ছাড়া বৃষ্টি বন্ধও হয় না। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃজন করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে অতঃপর তা দ্বারা তোমাদের জন্য ফলের রিজিক উৎপন্ন করেছেন এবং নৌকাকে তোমাদের আজ্ঞাবহ করেছেন, যাতে তার আদেশে সমুদ্রে চলাফেরা করে এবং নদনদীকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন।’ (সুরা ইবরাহিম : ৩২)। মানুষ যদি পাপে লিপ্ত হয়, সমাজে পাপাচার ছড়িয়ে পড়ে, তখন ঝড়-বৃষ্টির মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন করা হয়।

বাতাস ও ঝড় মানুষের জন্য উপকারী ও অপকারী দুটোই। তবে বাতাসকে গালমন্দ করা যাবে না। হাদিস শরিফে বাতাসকে গালমন্দ করতে নিষেধ করা হয়েছে। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘বাতাস আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণ নিয়ে আসে, আবার শাস্তিও নিয়ে আসে। অতএব তোমরা বাতাসকে গালমন্দ করো না, বরং আল্লাহর কাছে এর কল্যাণকর দিকটির প্রার্থনা করো এবং এর অকল্যাণকর দিকটি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করো।’ (আবু দাউদ)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি পুবালি হাওয়ার মাধ্যমে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছি এবং আদ জাতি পশ্চিমা হাওয়ার মাধ্যমে ধ্বংস হয়েছে।’ (বুখারি ও মুসলিম)। বাতাসের আগমন বৃষ্টিকে স্বাগত জানায়। নামে প্রবল বৃষ্টি। মেঘ-বৃষ্টি-ঝড় প্রকৃতির জন্য সুবাতাস বয়ে নিয়ে আসে, নিয়ে আসে অকল্যাণও। যা ক্ষতির কারণ হয়। বয়ে আনে দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষ শুধু অনাবৃষ্টি বয়ে আনে না, অতিবৃষ্টিও দুর্ভিক্ষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এই নয় যে, তোমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষিত হবে না; বরং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হচ্ছে, তোমাদের প্রতি প্রচুর বৃষ্টি বর্ষিত হবে অথচ জমিন কোনো কিছু উৎপাদন করবে না।’ (মুসলিম) বৃষ্টিতে কল্যাণ-অকল্যাণ দুটোরই সম্ভাবনা থাকে। কখনো মুসিবতের কারণ হয়ে দাঁড়ায় আবার কখনো রহমত হিসেবে আবির্ভূত হয়। মেঘলা আকাশ যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস বইতে থাকে তখন আল্লাহর আজাব-গজবের আশঙ্কা থাকে। কিন্তু কিছু বৃষ্টি আল্লাহর রহমত। এতে এরকম কোনো আশঙ্কা থাকে না। হাদিসে এসেছে, ‘মেঘাচ্ছন্ন আকাশ এবং প্রচণ্ড বাতাস দেখলে নবীজির (সা.) চেহারায় চিন্তার ছাপ ফুটে উঠত। তিনি এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিতেন। অতঃপর যদি ঝরঝরে বৃষ্টি হতো তিনি আনন্দিত হতেন এবং চেহারা থেকে দুশ্চিন্তার ছাপ চলে যেত।’ (মুসলিম ২৯৪)। বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হলে রাসুল (সা.) বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা সাইয়িবান নাফিয়া’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! মুষলধারায় উপকারী বৃষ্টি বর্ষণ করুন।’ (বুখারি : ১০২২)। আবার যখন বৃষ্টি খুব প্রবল আকারে বর্ষণ হতো, যা ক্ষতি সাধন করে তখন তিনি বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়ামা আলাইনা’ অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! বৃষ্টির আজাব আমাদের ওপর থেকে তাড়িয়ে নিন, আমাদের জন্য কল্যাণ দিন।’ (বুখারি : ১০০৩)।

রাসুল (সা.) বৃষ্টির সময় কিছু আমল করতেন। কখনো বৃষ্টি আল্লাহর রহমত, আবার কখনো গজব। রাসুল (সা.) বৃষ্টির সময় আল্লাহর রহমতের জন্য দোয়া করতেন। তিনি দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা সাইয়িবান নাফিয়াহ’ অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! আপনি এ বৃষ্টিকে প্রবহমান ও উপকারী করে দিন।’ (নাসায়ি : ১৫২৩)। দমকা হওয়া বইতে দেখলে রাসুল (সা.) আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যেতেন এবং উদ্বিগ্ন হয়ে চলাফেরা করতেন। যখন বৃষ্টি হতো তখন তিনি খুশি হতেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমার আশঙ্কা হয়, আমার উম্মতের ওপর কোনো গজব আসে কি না। বৃষ্টি দেখলেই তিনি বলতেন, রাহমাতান অর্থাৎ এটি আল্লাহর রহমত। (নাসায়ি : ১৯৬৯)। অন্য হাদিসে রয়েছে, আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) আকাশে মেঘ দেখলে নফল ইবাদত ছেড়ে দিতেন। এমনকি সালাতে উপবিষ্ট অবস্থায়ও। অতঃপর তিনি দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা ওয়া খাইরি ওয়া খাইরি মা উরসিলাত বিহি, ওয়া আউজুবিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি ওয়া শাররি মা উরসিলাত বিহি’, অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে বৃষ্টির উপকারী দিক কামনা করছি। আর অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাইছি।’ (আবু দাউদ : ৫১৯৯)। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দোয়া করতে হবে। রাসুল (সা.) একবার অতিরিক্ত বৃষ্টিতে দোয়া করেছিলেন—‘আল্লাহুম্মা হাওয়াইলাইনা ওয়া আলাইনা’, অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! আমাদের এখানে নয়, আশপাশে বৃষ্টি বর্ষণ করো।’ (নাসায়ি : ১৫২৭)। বৃষ্টি শেষ হয়ে এলে রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কিরামকে বিশেষ একটি দোয়া পড়ার তাগিদ দিয়েছেন—‘মুতিরনা বিফাদলিল্লাহি ওয়া রাহমাতিহ’। অর্থ—আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০৩৮)। উল্লেখ্য, মক্কার কাফেররা মনে করত আকাশের নক্ষত্রগুলো বৃষ্টি দেয়। অথচ এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। রাসুল (সা.) বৃষ্টির শেষে দোয়াটি পড়ে এটিই প্রমাণ করেছেন যে, আল্লাহতায়ালাই আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন। ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বজ্রপাত। রাসুল (সা.) যখন মেঘের গর্জন ও বজ্রধ্বনি শুনতে পেতেন তখন বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা লা তাকতুলনা বিগাদাবিকা ওলা তুহলিকনা বিআজাবিকা, ওয়া আফিনা কাবলা জালিক’ (হে আল্লাহ! তুমি আমাদের তোমার ক্ষোভ ও রোষের দ্বারা হত্যা করো না এবং আমাদের তোমার শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করো না, বরং আমাদের প্রশান্তি দান করো)’ (তিরমিজি)। বৃষ্টি উপভোগ করা এবং বৃষ্টির পানি গায়ে স্পর্শ করানো নবীজির (সা.) একটি আমল। মাঝেমধ্যে রাসুল (সা.) আল্লাহর রহমতের বারিধারায় নিজের শরীর ভিজিয়ে নিতেন। যখন বৃষ্টি শেষ হয়ে যেত তখন রাসুল (সা.) বলতেন, ‘মুতিরনা বি ফাদলিহি ওয়া রহমাতিহি’, অর্থাৎ, ‘আল্লাহর রহমত ও অনুকম্পায় বৃষ্টি বর্ষণ হয়েছে।’ (বুখারি : ৩৮)

অতি ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে বিজলি চমক ও বজ্রপাত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বজ্রপাতে অনেক সময় মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রিয় নবী (সা.) বিভিন্ন দোয়া শিখিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) যখন বজ্রের শব্দ শুনতেন তখন বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা লা তাকতুলনা বিগজাবিকা ওয়ালা তুহলিকনা বিআজাবিকা ওয়া আ-ফিনা কবলা জালিকা।’ (তিরমিজি : ৩৪৫০)। অন্য হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি বজ্রের আওয়াজ শুনে এ দোয়া পড়বে, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’, সে বজ্রে আঘাতপ্রাপ্ত হবে না। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২৯২১৩)।

মহান আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে এ প্রার্থনাই করি, বৃষ্টি যেন আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে এবং ঝড় ও বজ্রপাতের ক্ষতি থেকে যেন তিনি সবাই রক্ষা করেন।


   আরও সংবাদ