ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

হজ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের দুই নীতি

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ২৬ মে, ২০২৩ ১২:৫৮ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৮৪ বার


হজ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের দুই নীতি

মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সম্মিলন হজ। স্রষ্টার নৈকট্যলাভের আশায় প্রতিবছর মক্কার উদ্দেশে দেশের লাখো মুসলমান সৌদি আরব গমন করেন। তাদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে প্রতিবছর সরকার সৌদি আরব স্বাস্থ্যসেবা দল পাঠায়। যাদের কাজ মূলত হাজিদের সব ধরনের চিকিৎসা নিশ্চিত করা। গত রোববার শুরু হয়েছে হজ ফ্লাইট। এদিকে হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দল গঠনের ক্ষেত্রে ইতোপূর্বে হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দলের সঙ্গে সৌদি যাননি এমন ব্যক্তিদের আবেদনের নির্দেশনা দিয়েছে। অন্যদিকে ধর্ম মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে বলছে, এখন থেকে পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দল গঠন করা হবে। ইতোপূর্বে স্বাস্থ্যসেবা দলের সদস্য হিসেবে সৌদি গেছেন এমন বেশ কয়েকজন এ বছরও সৌদি যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যসেবা দল গঠন নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের দুই নীতি বিষয়ে চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে।

একাধিক নার্স অভিযোগ করে বলেন, হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দলের নামে কিছু মানুষ বারবার বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ নিচ্ছেন। এক ব্যক্তি একাধিকবার হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দলের সঙ্গে সৌদি গমনের কারণে অন্যরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ইতোপূর্বে যারা হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দলের সঙ্গে সৌদি আরব গেছেন, তাদের বক্তব্য আবার ভিন্ন। তাদের মতে, দেশের বাইরে ভিন্ন পরিবেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে দল গঠন প্রয়োজন। নয়তো অনভিজ্ঞতার কারণে হাজিদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।

এ বছর হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দল গঠনের লক্ষ্যে গত ১৩ এপ্রিল নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) নাসির উদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘২০২৩ সালে হজ স্বাস্থ্যসেবা দল গঠনের লক্ষ্যে হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা নীতিমালা ২০১৮ অনুযায়ী নার্সিং কর্মকর্তা নির্বাচনের লক্ষ্যে যোগ্য নার্সিং কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দরখাস্ত আহ্বান করা যাচ্ছে।

আবেদনের সঙ্গে ইতোপূর্বে হজ মিশনে গমন করেননি মর্মে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়নপত্র আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ইতোপূর্বে হজ মিশনে এক বা একাধিকবার গমন করেছেন, তাদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই।’ একাধিক নার্স ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের সুস্পষ্ট নির্দেশনা না মেনে একাধিকবার হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দলের সঙ্গে সৌদি আরব গমন করেছেন—এমন ব্যক্তিরা এ বছরও যাচ্ছেন। তাহলে তারা কীভাবে আবেদন করলেন।

গত ১৪ মে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল কাশেম মুহাম্মদ শাহীন স্বাক্ষরিত অন্য বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এবার হজ মৌসুমে সৌদি আরবে অসুস্থ বাংলাদেশি হাজিদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য দুটি দলে বিভিক্ত করে ১০২ জন চিকিৎসক, ৬৩ জন নার্স ও ব্রাদার্স, ২১ জন ফার্মাসিস্ট এবং ১৪ জন অপারেশন থিয়েটার ও ল্যাব অ্যাসিস্টট্যান্টের সমন্বয়ে ২০০ সদস্যবিশিষ্ট সমন্বিত হজ চিকিৎসক দল গঠন করে সৌদি আরব প্রেরণে সরকারের সম্মতি জ্ঞাপন করছি। হজ চিকিৎসক দলের সদস্যরা পর্যায়ক্রমে তাদের নামের বিপরীতে উল্লিখিত তারিখ অনুযায়ী বিমানের ফ্লাইট প্রাপ্তি সাপেক্ষে সৌদি আরব গমন করবেন এবং দায়িত্ব পালন শেষে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন।’ তালিকায় ১৩০ নম্বরে নাম রয়েছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ইয়াসমিনের। তিনি ২০১৫ সালেও হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দলের সদস্য হয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। ওই বছর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ চিকিৎসক দলের ৯৬ জনের তালিকায় ৬৬ নম্বরে তার নাম ছিল। এবারও তিনি সমন্বিত হজযাত্রী চিকিৎসক দলের সঙ্গে সৌদি আবর যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রণীত হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০২২ অনুসারে অভিজ্ঞ জনবল থেকে ২৫ শতাংশ চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে সমন্বিত চিকিৎসক দল গঠনের কথা বলা হয়েছে। সেই হিসেবে সরকার আমাকে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ২০১৫ সালে আমি আবেদন করিনি। আমি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, সেই কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে যেহেতু ২৫ শতাংশ পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে—এমন জনবল নিয়ে দল গঠন করা হবে, তাই আমি প্রতিবছর আবেদন করব।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের এ বছরের বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা নীতিমালা-২০১৮-এর একটি কপি সংযুক্ত করে দিয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা নীতিমালা-২০১৮-এর ৭ ধারার তিন অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘একবার হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দলের সঙ্গে সৌদি আরব গমন করে থাকলে পরবর্তী বছর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আবেদন করতে পারবেন না।’ অন্যদিকে হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২২-এর ২৫(ঘ)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত সমন্বিত হজ চিকিৎসক টিমের দায়িত্ব ও প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা অনুসারে বলা হচ্ছে, ‘যাদের পূর্বে এই টিমে গমনের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের মধ্য থেকে অন্তত ২৫ শতাংশ লোকবল নিয়ে দল গঠন করতে হবে।’ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের গত ২৮ মার্চ জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের ৩ ধারার ১৮নং উপধারায় বলা হয়েছে, হজ সমন্বিত চিকিৎসক টিমের সব ক্যাটাগরির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ পূর্বে হজ সমন্বিত চিকিৎসক টিমের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। একাধিক নার্স অভিযোগ করে বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এই অভিজ্ঞতার মানদণ্ড কী?

এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএনএ)। অভিযোগে বলা হয়েছে, হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দলে ১০২ জন চিকিৎসককে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুসারে একজন চিকিৎসকের অনুপাতে নার্স হবে তিনজন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এখানে প্রতি ১০ জন চিকিৎসকের বিপরীতে মাত্র ৬ জন নার্স পাঠানো হচ্ছে।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অধিশাখার উপসচিব মঞ্জুরুল হক বলেন, হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনা আইন-২০২১ এবং হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০২২-এর আলোকে এখন হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দল গঠন করা হয়েছে। বিধিমালায় বলা হয়েছে, পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে এমন স্বাস্থ্যকর্মীদের সমন্বয়ে দল গঠন হবে।

দুই মন্ত্রণালয়ের দুই নীতি সম্পর্কে জানতে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) উপসচিব নাসির উদ্দিন  বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিধিমালা আমরা অফিসিয়ালি পাইনি। আমাদের জানার কথাও নয়। হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দল গঠনের ক্ষেত্রে নতুনদের সুযোগ সৃষ্টি করতে চেয়েছি। যারা অতীতে গেছেন তাদের বাদ দিয়ে নতুনদের সুযোগ দিতে চেয়েছি। এ জন্য ইতোপূর্বে যারা হজযাত্রী স্বাস্থ্যসেবা দলের সঙ্গে সৌদি গিয়েছেন তাদের আবেদন না করতে নিরুসাহিত করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে আমাদের তালিকায় কাউকে রিপিট করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। মন্ত্রণালয় (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়) তো আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। তারা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিধিমালা ফলো করে কাউকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন কি না, সে বিষয়ে জানা নেই।


   আরও সংবাদ