আমির হোসেন মামুন
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪ ১২:১২ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ১৬০ বার
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন : রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করবে, এটা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, তোমার রাব্ব তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে। [সূরা ১৭, আল ইসরা-৭৯]
--- রাতের কিয়দংশে তাঁর প্রতি সাজদাবনত হও, আর রাতের দীর্ঘ সময় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। [সূরা ৭৬, আদ দাহর-২৬]
রাত্রি জাগরণ কর (ইবাদাতের জন্য), কিছু অংশ ব্যতীত, অর্ধ রাত কিংবা তদপেক্ষা অল্প অথবা তদপেক্ষা বেশি। [সূরা ৭৩, আল মুয্যাম্মিল-২-৪]
তাহাজ্জুদ সালাত আদায়ের গুরুত্ব
=========================
১। নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ফারয সালাতের পর সবচেয়ে ফাযীলাতের সালাত হল রাতের (তাহাজ্জুদ) সালাত। [মুসলিম/২৬২২-আবূ হুরাইরা (রাঃ), তিরমিযী/৪৩৮, নাসাঈ/১৬১৬]
২। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : হে আবদুল্লাহ! সেই ব্যক্তির মত হবেনা যে রাতে জাগে, কিন্তু তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করেনা। [নাসাঈ/১৭৬৭-আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ), ইব্ন মাজাহ/১৩৩১]
৩। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : মহামহিম আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন, কে আছে এমন যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে এমন যে আমার কাছে প্রার্থনা করবে? আমি (তার প্রার্থিত বস্তু) তাকে দান করব। কে আছে এমন যে আমার কাছে ক্ষমা চাবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। [বুখারী/১০৭৪, তিরমিযী/৪৪৬, মুসলিম/১৬৪২, ১৬৪৩, ১৬৪৪, ইব্ন মাজাহ/১৩৬৬, আবূ দাউদ/১৩১৫]
৪। আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তির উপর রাহম করুন যে রাতের কিছু অংশ জেগে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করে, অতঃপর তার স্ত্রীকেও জাগিয়ে দেয়, সেও তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করে। যদি তার স্ত্রী জাগতে না চায় তাহলে তার মুখম-লে পানির ছিটা দেয়। ঐ মহিলার উপরও আল্লাহ তা‘আলা রাহম করুন যে রাতের কিছু অংশ জেগে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করে, অতঃপর তার স্বামীকেও জাগিয়ে দেয়, সেও তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করে। সে যদি জাগতে না চায় তাহলে তার মুখম-লে পানির ছিটা দেয়। [নাসাঈ/১৬১৩, ইব্ন মাজাহ/১৩৩৬, আবূ দাউদ/১৩০৮]
৫। নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমাদের কেহ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন শাইতান তার গ্রীবাদেশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে তাকে এই বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত। তারপর সে যদি জেগে আল্লাহকে স্মরণ করে তাহলে একটি গিঁট খুলে যায়, পরে উযু করলে আর একটি গিঁট খুলে যায়, তারপর সালাত আদায় করলে আর একটি গিঁট খুলে যায়। তখন তার প্রফুল্ল মনে ও নির্মল চিত্তে সকাল হয়। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলুষিত মনে ও অলসতা নিয়ে। [বুখারী/১০৭১-আবূ হুরাইরা (রাঃ), মুসলিম/১৬৮৯, নাসাঈ/১৬১০, ইব্ন মাজাহ/১৩২৯, আবূ দাউদ/১৩০৬]
তাহাজ্জুদ সালাত আদায়ের ফাযীলাত
=========================
তারা শয্যাত্যাগ করে তাদের রাব্বকে ডাকে আশা ও আশংকায় এবং আমি তাদেরকে যে রিয্ক দান করেছি তা হতে তারা ব্যয় করে। কেহই জানেনা তাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর কী লুকায়িত রাখা হয়েছে তাদের কৃতকর্মের পুরস্কারস্বরূপ! [সূরা ৩২, আস সাজদা-১৬-১৭]
৬। আবূ দারদা (রাঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি রাতে উঠে সালাত পড়ার নিয়াত করে (ঘুমাতে) তার বিছানায় যায়, কিন্তু ঘুমের অধিক্যের কারণে তার ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো, তাকে তার নিয়াত অনুযায়ী সাওয়াব দেয়া হবে। তার এই ঘুম তার রবের পক্ষ থেকে তার জন্য দান খাইরাত হিসেবে গন্য হবে। [ইব্ন মাজাহ/১৩৪৪]
তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়ার পর য্কির ও দু‘আসমূহ
==========================
৭। (ক) নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য যখন নিদ্রা থেকে উঠতেন তখন সূরা ‘আলে ইমরানের’ শেষের দশটি আয়াত পাঠ করতেন। অতঃপর উযূ করে তাহাজ্জুদ সালাত সমাপ্ত করতেন। [বুখারী/৪২০১, ৪২০২, ৪২০৩, নাসাঈ/১৬২৩]
(খ) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিদ্রা থেকে উঠেই উযূ করার পূর্বে নিম্নে বর্ণিত যিকর করতেন : (আল্লাহু আকবার) দশবার, (আলহামদুলিল্লাহ্) দশবার, (সুবহানাল্লাহ) দশবার, (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) দশবার এবং (আস্তাগফিরুল্লাহ) দশবার। আর বলতেন : আল্লাহুম্মাগফিরলী ওয়াহদিনী ওয়ারযুকনী ওয়াআফিনী আউযু বিল্লাহী মিন যীকিল মাকামি ইয়াওমাল কিয়ামাহ। [নাসাঈ/১৬২০, ইব্ন মাজাহ/১৩৫৬]
(গ) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়ে এ দু‘আ পাঠ করতেন : “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর, আল হামদুলিল্লাহি, ওয়া সুবহানাল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা হাওলা ওয়া লা কূওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।” অতঃপর বলেছেন : কেহ যদি অন্য যে কোন বিষয়ে দু‘আ করে, তার দু‘আ কবূল করা হয়। এরপর উযূ করে সালাত আদায় করলে তার সালাত কবূল করা হয়। [বুখারী/১০৮২-উবাদা ইবনুস সামিত (রাঃ)]
(ঘ) রবী‘আ ইব্ন কা‘ব আসলামী (রাঃ) বলেন : আমি নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুজরার পাশেই রাত্রি যাপন করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন রাত্রে জাগ্রত হতেন অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে আমি বলতে শুনতাম : “সুবহানাল্লাহী রাব্বিল আলামিন” অতঃপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত “সুবহানাল্লাহী ওয়া বিহামদিহী।” [নাসাঈ/১৬২১]
৮। হুযাইফা (রাঃ) বলেছেন : নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের বেলা যখন তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য উঠতেন তখন মিসওয়াক দ্বারা তাঁর মুখ (দাঁত) পরিষ্কার করতেন। [বুখারী/১০৬৫, নাসাঈ/১৬২৪]
তাহাজ্জুদ সালাতের কাযা আদায়
==========================
৯। আসওয়াদ (রাঃ) বলেছেন, আমি আয়িশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম : রাতের বেলা নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সালাত কেমন ছিল? জবাবে তিনি বলেছেন : তিনি প্রথমাংশে ঘুমাতেন, শেষাংশে জেগে সালাত আদায় করতেন। [বুখারী/১০৭৫, মুসলিম/১৫৯৮, ইব্ন মাজাহ/১৩৬৫]
১০। আয়িশা (রাঃ) বলেছেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নিদ্রা, অসুখ-বিসুখ বা ব্যথা-বেদনার কারণে রাতে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতে পারতেননা, তখন তিনি দিনের বেলা ফাজর ও যুহরের সালাতের মাঝে বার রাক‘আত সালাত আদায় করে নিতেন। [মুসলিম/১৬১৫, তিরমিযী/৫৮১, নাসাঈ/১৭৯২]
তাহাজ্জুদ সালাত আদায়ের নিয়ম-কানূন
===========================
১১। রামাযান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাতের সালাত কিরূপ ছিল জিজ্ঞেস করায় আয়িশা (রাঃ) বলেছেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান মাসে এবং রামাযান মাস ছাড়াও রাতে এগার রাক‘আতের অধিক সালাত আদায় করতেননা। [মুসলিম/১৫৯৩, বুখারী/১০৭৬]
১২। রাতের (তাহাজ্জুদ) সালাত দুই দুই রাক‘আত করে আদায় করতে হয় (অর্থাৎ প্রতি দুই রাক‘আতে সালাম ফিরাতে হয়)। [মুসলিম/১৬১৮, ১৬৩৩, নাসাঈ/১৬৭৪, বুখারী/১০৬৬, ইব্ন মাজাহ/১৩১৮, আবূ দাউদ/১৩২৬]
১৩। আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেছেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের (সুন্নাত/নফল) সালাত আদায়কালে কখনও কির‘আত আস্তে এবং কখনও জোরে পাঠ করতেন। [আবূ দাউদ/১৩২৮]
তাহাজ্জুদ সালাতের রাক‘আতের সংখ্যা
==============================
১৪। রাতের সালাত ১১ রাক‘আত : দুই দুই করে ৮ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ৩ রাক‘আত বিতর। [বুখারী/১০৬৮, ১০৭৬, মুসলিম/১৫৯৩, নাসাঈ/১৭১০, আবূ দাউদ/১৩৪১, ইব্ন মাজাহ/১৩৫৮]
অথবা দুই দুই রাক‘আত করে ৬ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ৫ রাক‘আত বিতর। [আবূ দাউদ/১৩৫৯]
অথবা দুই দুই রাক‘আত করে মোট ১০ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ১ রাক‘আত বিতর। [মুসলিম/১৫৮৭, তিরমিযী/৪৪০, বুখারী/৪৫৯, ৯৩২, ১০৬৬, আবূ দাউদ/১৩৩৫]
১৫। রাতের সালাত ১৩ রাক‘আত : দুই দুই রাক‘আত করে ৮ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ৫ রাক‘আত বিতর। [মুসলিম/১৫৯০, আবূ দাউদ/১৩৩৮, ১৩৫৮]
অথবা দুই দুই রাক‘আত করে ১২ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ১ রাক‘আত বিতর। [মুসলিম/১৬৭৪, তিরমিযী/৪৪৪, আবূ দাউদ/১৩৬৬]
অথবা দুই দুই রাক‘আত করে ৮ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ৩ রাক‘আত বিতর ও ২ রাক‘আত ফাজরের সুন্নাত। [বুখারী/১০৬৯, মুসলিম/১৫৯২, নাসাঈ/১৭১০, ইব্ন মাজাহ/১৩৬১, আবূ দাউদ/১৩৪০]
অথবা দুই দুই রাক‘আত করে ১০ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ১ রাক‘আত বিতর ও ২ দুই রাক‘আত ফাজরের সুন্নাত। [মুসলিম/১৫৯৭, আবূ দাউদ/১৩৩৪]
১৬। রাতের সালাত ৯ রাক‘আত : দুই দুই রাক‘আত করে ৬ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ৩ রাক‘আত বিতর। [বুখারী/১০৬৮, মুসলিম/১৬৬৯, আবূ দাউদ/১৩৫৩]
অথবা দুই দুই রাক‘আত করে ৮ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ১ রাক‘আত বিতর। [মুসলিম/১৫৬৯, তিরমিযী/৪৪৩, ৪৪৪]
১৭। রাতের সালাত ৭ রাক‘আত : দুই দুই রাক‘আত করে ৬ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ১ রাক‘আত বিতর। অথবা দুই দুই রাক‘আত করে ৪ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ৩ রাক‘আত বিতর। [বুখারী/১০৬৮, আবূ দাউদ/১৩৬২]
১৮। রাতের সালাত ৫ রাক‘আত : দুই দুই রাক‘আত করে ৪ রাক‘আত তাহাজ্জুদ। অতঃপর ১ রাক‘আত বিতর। [আবূ দাউদ/১৩৫৬]
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত আল কুরআন ও হাদীস গ্রন্থ হতে সংকলিত।