আমির হোসেন মামুন
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারী, ২০২৪ ১৭:৪১ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ১৮৮ বার
বিতর অর্থ : বেজোড়। ইশা, কিয়ামুল লাইল, সালাতুল লাইল, তাহাজ্জুদ, কিয়ামে রামাযান, তারাবী ও রাতের সালাত শেষে বিতর সালাত আদায় করতে হয়।
বিতর সালাতের গুরুত্ব
======================
১। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : বিতর সালাত (আদায় করা) প্রত্যেক মুসলিমের জন্য হক। [আবূ দাউদ/১৪২২]
২। আবূ সালামা ইব্ন আব্দুর রাহমান (রাঃ) বলেন, আমি উম্মুল মু’মিনীনা আয়িশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম : রামাযান মাসে (রাতের বেলা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সালাত কেমন ছিল? জবাবে তিনি বললেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান মাসে এবং রামাযান মাস ছাড়া অন্যান্য সময় (রাতের বেলা) এগার রাক‘আতের অধিক সালাত আদায় করতেননা। চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন। তুমি তার (সর্বাঙ্গীঁন) সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করনা (কারণ এর সৌন্দর্য ছিল বর্ণনাতীত)। অতঃপর চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন, এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করনা। অতঃপর তিনি তিন রাক‘আত (বিতর) সালাত আদায় করতেন। আয়িশা (রাঃ) বলেছেন, (একদিন) আমি জিজ্ঞেস করলাম : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি বিতরের আগে ঘুমিয়ে থাকেন? জবাবে তিনি বললেন : আমার চোখ দুইটি ঘুমায়, কিন্তু আমার হৃদয় ঘুমায়না। [বুখারী/১০৭৬]
৩। আবদুল্লাহ ইব্ন উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদিন জনৈক লোক আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাতের সালাত প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন : রাত্রিকালীন সালাত হল দুই রাক‘আত দুই রাক‘আত করে। সুতরাং তোমাদের কেহ যদি রাতে সালাত আদায় করতে করতে ভোর হওয়ার আশঙ্কা করে, তখন সে এক রাক‘আত আদায় করবে, যা তার রাতের নাফল সালাতকে বিতর (বিজোড়) করে দিবে। নাফি হতে বর্ণিত যে, আবদুল্লাহ ইব্ন উমার বিতর সালাতে দুই রাক‘আতের পরে সালাম ফিরাতেন এর পরে আর এক রাক‘আত আদায় করে সালাম ফিরাতেন। এর মাঝে কোন প্রয়োজনীয় কাজের নির্দেশ দিতেন। [বুখারী/৯৩২]
৪। আলী (রাঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : হে কুরআনের অনুসারীগণ! তোমরা বিতর সালাত আদায় কর। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বেজোড় (একক), কাজেই তিনি বেজোড়কে (বিতর) ভালবাসেন। [আবূ দাউদ/১৪১৬]
বিতর সালাত আদায়ের সময়
=========================
৫। নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : বিতরকে তোমাদের রাতের শেষ সালাত কর। [বুখারী/৯৩৯, বুখারী/৪৫৮, তিরমিযী/৪৩৭, নাসাঈ/১৬৮৫, মুসলিম/১৫৯৯]
৬। একই রাতে দুইবার বিতরের সালাত আদায় করা যায়না। [আবূ দাউদ/১৪৩৯, নাসাঈ/১৬৮২]
৭। যে ব্যক্তি নিদ্রা বা ভুলের কারণে বিতরের সালাত আদায় করেনি সে যেন তা স্মরণ হওয়ার পরপরই আদায় করে নেয়। [আবূ দাউদ/১৪৩১, তিরমিযী/৪৬৫, ৪৬৬, মুসলিম/১৬২৩, নাসাঈ/১৬৮৮, ইবন মাজাহ/১১৮৮]
৮। রাতের সব অংশেই রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতর আদায় করেছেন। রাতের প্রথম অংশে, মাঝরাতে এবং শেষ রাতে। শেষ পর্যায়ে তাঁর বিতরের অভ্যাস ছিল সাহরীর সময়। [মুসলিম/১৬০৭, বুখারী/৯৩৭, তিরমিযী/৪৫৭, ইব্ন মাজাহ/১১৮৬, আবূ দাউদ/১৪৩৫]
বিতর সালাত আদায় করার নিয়ম ও রাক‘আতের সংখ্যা
===========================
৯। বিতর সালাত ১ রাক‘আত :
===============================
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক রাক‘আত বিতর সালাত আদায় করতেন এবং উম্মাতকেও এক রাক‘আত আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। [বুখারী/৪৫৯, ৯৩৪, ৯৩৬, ১০৬৬, তিরমিযী/৪৬১, মুসলিম/১৫৮৭, ১৫৮৮, ১৫৯৭, ১৬১৯, ১৬৭৪, নাসাঈ/১৬৯২, ১৭১৩, ইব্ন মাজাহ/১১৭৪, ১১৭৭, ১১৯০, আবূ দাউদ/১৩৩৫, ১৩৬৬, ১৩৬৭, ১৪২১]
১০। বিতর সালাত ৩ রাক‘আত :
=================================
(ক) নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন রাক‘আত বিতর সালাত আদায় করেছেন। [বুখারী/৯৩৪, নাসাঈ/১৭১৩, তিরমিযী/৪৬০, ইব্ন মাজাহ/১১৯০, মুসলিম/১৫৯৩, আবূ দাউদ/১৩৪১, ১৪২২]
(খ) আবদুল্লাহ ইব্ন উমার বিতর সালাতে দুই রাক‘আতের পরে সালাম ফিরাতেন এর পরে আর এক রাক‘আত আদায় করে সালাম ফিরাতেন। [বুখারী/৯৩২]
(গ) আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমরা তিন রাক‘আত বিতর সালাত মাগরিবের সালাতের মত আদায় করবেনা (অর্থাৎ মাগরিবের সালাতের মত তিন রাক‘আত বিতরের ২য় রাক‘আতে আত্তাহিয়াতু পাঠ করবেনা, বরং একটানা তিন রাক‘আত আদায় করার পর আত্তাহিয়্যাতু, দুরূদ ও দু‘আয়ে মাসুরা পড়ে সালাম ফিরাতে হবে)। [দারাকুতনী, নাইলুল আওতার, বাইহাকী/৩য় খন্ড, ৪১-৪৩ পৃষ্ঠা]
১১। বিতর সালাত ৫ রাক‘আত :
=============================
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঁচ রাক‘আত বিতর আদায় করেছেন। এর শেষ রাক‘আত ছাড়া কখনও বসতেননা। [মুসলিম/১৫৯০, তিরমিযী/৪৫৯, ইব্ন মাজাহ/১১৯০, ১১৯২, নাসাঈ/১৭১৩, ১৭২০, আবূ দাউদ/১৩৩৮, ১৪২২]
১২। বিতর সালাত ৭ রাক‘আত :
===========================
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতরের সালাত সাত রাক‘আতও আদায় করেছেন এবং শেষ রাক‘আতেই শুধু বসতেন ও সালাম ফিরাতেন। [নাসাঈ/১৭২১, ইব্ন মাজাহ/১১৯২]
১৩। বিতর সালাত ৯ রাক‘আত :
===============================
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নয় রাক‘আত বিতর সালাত আদায় করেছেন। তিনি এর মাঝে আর বসতেননা, অষ্টম রাক‘আত ব্যতীত (অর্থাৎ অষ্টম রাক‘আতে তাশাহ্হুদ পাঠ করে উঠে পুনরায় নবম রাক‘আত আদায় করে সালাত শেষ করতেন)। [মুসলিম/১৬০৯, ইব্ন মাজাহ/১১৯১, নাসাঈ/১৭২৩]
দু‘আ কুনূত পাঠ করার নিয়ম
========================
১৪। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতে রুকূর পর একমাসব্যাপী দু‘আ কুনূত পাঠ করেছেন। [মুসলিম/১৪১৩-আবূ সালামা (রাঃ)]
১৫। আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতর সালাতের মাধ্যমে মু’মিনদের জন্য দু‘আ করেন এবং কাফিরদের অভিসম্পাত দেন। [বুখারী/৭৫৮, আবূ দাউদ/১৪৪০, মুসলিম/১৪১১]
১৬। বিতর সালাতের বা অন্য ওয়াক্তের ফারয সালাতের শেষ রাক‘আতে রুকূর পর দাঁড়িয়ে বা রুকূর আগে দু‘আ কুনূত পাঠ করা যায়। [বুখারী/৯৪২, বুখারী/৯৪৩, ইব্ন মাজাহ/১১৮৩] (বিতর সালাত হাদীস মোতাবেক শেষ রাক‘আতে রুকূর পূর্বে সূরা ফাতিহা, অন্য সূরা এবং দু‘আ কুনূত এক সঙ্গে পাঠ করতে হয়, অথবা রুকূর পর দাঁড়িয়ে মুনাজাতের ন্যায় হাত তুলে দু‘আ কুনূত পাঠ করতে হয়। কিন্তু দেখা যায় কেহ কেহ শেষ রাক‘আতে সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা পাঠ করার পর তাকবীর তাহরীমার ন্যায় আবার তাকবীর দিয়ে হাত বুকে বেঁধে দু‘আ কুনূত পাঠ করে, এরূপ নিয়ম সহীহ হাদীসে পাওয়া যায়না)
১৭। মাগরিব ও ফাজরের ফারয সালাতের শেষ রাক‘আতে দু‘আ কুনূত পাঠ করা যায়। [বুখারী/৯৪৪, ৭৫৯, মুসলিম/১৪২৬]
১৮। যুহর, ইশা ও ফাজরের ফারয সালাতের শেষ রাক‘আতে দু‘আ কুনূত পাঠ করা যায়। [বুখারী/৭৫৮, আবূ দাউদ/১৪৪০, মুসলিম/১৪১৫]
১৯। আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেছেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক মাস যাবত ইশার সালাতে দু‘আ কুনূতে নাযেলাহ্ পাঠ করেন : দু‘আ কুনূতে নাযেলাহ অর্থ : “ইয়া আল্লাহ! আপনি ওলীদ ইব্ন ওলীদকে মুক্তি দান করুন। ইয়া আল্লাহ! আপনি সালামা ইব্ন হিশামকে মুক্তি দিন। ইয়া আল্লাহ! আপনি সামর্থহীন দুর্বল মু’মিনদেরকে নাজাত দান করুন। ইয়া আল্লাহ! মুযাব গোত্রের উপর আপনার আযাব শক্ত করুন। ইয়া আল্লাহ! আপনি তাদের উপর ইউসুফের (আঃ) সময়ের মত করাল দুর্ভিক্ষ আপতিত করুন।” একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফাজরের সালাতের সময় তাদের জন্য এরূপ দু‘আ না করায় আমি তাঁকে তা স্মরণ করিয়ে দেই। তখন তিনি বললেন : তুমি কি দেখনা যে, তারা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে মাদীনায় চলে এসেছে? [আবূ দাউদ/১৪৪২]
২০ । ইমাম যখন দু‘আ কুনূত পাঠ করবে তখন মুক্তাদীগণ আমীন বলবে। [আবূ দাউদ/১৪৪৩-ইব্ন আব্বাস (রাঃ)]
দু‘আ কুনূতসমূহ
=================
২১। দু‘আ কুনূত :
اَللهم اهْدِنِيْ فِيمَنْ هَدَيْتَ وَعَافِنِيْ فِيمَنْ عَافَيْتَ وَتَوَلَّنِيْ فِيمَنْ تَوَلَّيْتَ وَبَارِكْ لِيْ فِيْمَا أَعْطَيْتَ وَقِنِيْ شَرَّ مَا قَضَيْتَ فَإِنَّكَ تَقْضِيْ وَلاَ يُقْضَىْ عَلَيْكَ وَإِنَّهُ لَا يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ وَلاَ يَعِزُّ مَنْ عَادَيْتَ تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ.
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাহদিনী ফীমান হাদাইতা ওয়া ‘আফিনী ফিমান’ ‘আফাইতা ওয়া তাওয়াল্লানী ফীমান তাওয়াল্লাইতা ওয়া বারিক লী ফীমা আ‘তাইতা ওয়া কিনী র্শারা মা কাযাইতা, ফা ইন্নাকা তাকযী ওয়ালা ইউকযা আলাইকা ইন্নাহু লা ইয়ায্লিলু মান ওয়ালাইতা। ওয়ালা ইয়া ‘ইয্যু মান্ ‘আদাইতা, তাবারাক্তা রাব্বানা ওয়া তা‘আলাইতা।
অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি যাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছ আমাকে ঠিক সেই পথে পরিচালিত কর এবং যাদেরকে নিরাপদে রেখেছ আমাকেও তাদের দলভুক্ত কর, তুমি যে অমঙ্গল নির্দিষ্ট করেছ তা হতে আমাকে রক্ষা কর; কারণ তুমিই ভাগ্য নির্ধারণকারী, তোমার উপর কেহ ভাগ্য নির্ধারণ করার নেই, তুমি যার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছ সে কখনও অপমানিত হবেনা এবং তুমি যার সাথে শত্রুতা করেছ সে কখনও সম্মানিত হতে পারেনা। তুমি বারাকাতময় ও সুমহান। [আবূ দাউদ/১৪২৫, তিরমিযী/৪৬৪, ইব্ন মাজাহ/১১৭৮]
২২। দু‘আ কুনূত :
اَللهم إِنِّيْ أَعُوذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ وَبِمُعَافَاتِكَ مِنْ عُقُوْبَتِكَ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْكَ لاَ أُحْصِيْ ثَنَاءً عَلَيْكَ أَنْتَ كَمَا أَثْنَيْتَ عَلٰى نَفْسِكَ.
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নী আ’উযু বিরিযাকা মিন সাখাতিকা ওয়া বিমু‘আফাতিকা মিন উকূবাতিকা ওয়া আ‘উযুবিকা মিনকা লা উহ্সী সানাআন আলাইকা আনতা কামা আসনাইতা ‘আলা নাফসিকা।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টির মাধ্যমে তোমার ক্রোধ হতে নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি এবং তোমার ক্ষমার মাধ্যমে তোমার আযাব হতে রক্ষা চাই এবং তোমার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি তোমার প্রশংসা পরিমাপ করতে অক্ষম। তুমি নিজে নিজের যেমন প্রশংসা করেছ তুমি তেমনই। [আবূ দাউদ/১৪২৭, ইব্ন মাজাহ/১১৭৯]
বিতর সালাতের অন্যান্য নিয়মাবলী
=========================
২৩। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতরের পর বসে দুই রাক‘আত (সুন্নাত/নাফল) সালাত আদায় করতেন। [তিরমিযী/৪৭১, নাসাঈ/১৭২২, ইব্ন মাজাহ/১১৯৫, আবূ দাউদ/১৩৫১]
২৪। সফর করা অবস্থায় বিতর সালাত আদায় করতে হবে। [বুখারী/৯৪১]
২৫। বিতরের সালাতে কিরা‘আত জোরে অথবা আস্তে উভয় অবস্থায় পাঠ করা যায়। [আবূ দাউদ/১৪৩৭]
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত আল কুরআন ও হাদীস গ্রন্থ হতে সংকলিত।