ঢাকা, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

‘ভয়াবহ’ ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দেশ

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ২২ নভেম্বর, ২০২৫ ০৯:৪২ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ১২ বার


‘ভয়াবহ’ ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দেশ

একশ বছরের মধ্যে দেশে উৎপত্তি হওয়া সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প দেখলো দেশবাসী, যা ‘ভয়াবহ’ ভূকম্পনের পূর্বাভাস বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। এখনই প্রস্তুতি না নিলে ঘটতে পারে মহামারি। বিশেষ করে রাজধানীতে ক্ষয়ক্ষতি হতে পরে অবর্ণনীয়।

রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭ মাত্রায় যে ভূমিকম্পটি নরসিংদীর মাধবদীতে হলো, তা মাঝারি মানের বলছেন আবহাওয়াবিদরা। এতেই রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাণ গেল ১০ জনের। মাটিতেও ফাটল ধরেছে। রাজধানীতে ভবন ধসে পড়া বা হেলে পড়া, ফাটল ধরার মতো ঘটনা ঘটেছে। ভূমিকম্পনের কারণ জানা গেলেও এটি রুখে দেওয়ার মতো কোনো পদ্ধতি বা প্রযুক্তি আজও আবিষ্কৃত না হওয়ায় সচেতনতা অবলম্বনকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভূমিকম্পের কারণ
পৃথিবীর উপরিভাগ অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। এগুলো আগে একত্রে থাকলেও এখন আলাদা হয়ে গেছে। এই পৃথক পৃথক অংশগুলোকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। ভূগর্ভস্থ নানা পদার্থের কারণে চাপ সৃষ্টি হলে প্লেটগুলো একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়। ফলে ওয়েভ (তরঙ্গ) সৃষ্টি হয়। সেই তরঙ্গের শক্তির ওপরই আসলে নির্ভর করে ভূমিকম্পের মাত্রা, যা পৃথিবীর উপরিভাগেও অনুভূত হয়। এর ফলে যে ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়, সেটা আসলে ভূমিকম্প। শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে মাধবদীর ভূমিকম্পও হয়েছে টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের কারণে।

ভূমিকম্প পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট কিছু ভূকম্পন হয়। আবার ছোট ছোট ভূকম্পনের ফলে ভূগর্ভের জমে থাকা শক্তিও কমে যায়। রংপুরসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলকে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে আগেই ঘোষণা করেছে আবহাওয়া অফিস। সেই দিক থেকে ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বাইরে মেঘালয়ের ডাউকি ফল্টের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলও ঝুঁকিপূর্ণ।

ভূমিকম্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, আমাদের যতদূর জানা, সম্ভবত ১৮৯৭ সালের দিকে সিলেট অঞ্চলে একটা বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ভূমিকম্পের একটা ধরণ হচ্ছে, পিরিয়ডোক্যালি (নির্দিষ্ট সময় পরপর) বড় ভূমিকম্প হয়। সেগুলো সাধারণত একশ বছর পরপর ঘুরে আসে।
ভূমিকম্প

বাংলাদেশকে তিনটা জোনে ভাগ করা হয়েছে। একটা হলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, একটা হলো মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ ও আরেকটা হলো কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুরের কিছু অংশ ও চট্টগ্রাম অঞ্চল অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে পড়েছে।

তাই এসব অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস নেই এবং ১২০ থেকে ১২৫ পূর্বে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, তাই এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং বড় ভূমিকম্প হতেই পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ফল্ট লাইনে বড় ভূমিকম্প হয়। আর বাংলাদেশ ফল্ট লাইনের আশপাশের দেশ। সেই হিসেবে বড় ভূকম্পনে বড় প্রভাব পড়বে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে উৎপন্ন হওয়া প্রত্যেকটা বড় ভূকম্পনের প্রভাবই দেশে বড় করেই এসেছে। 

১৮৬৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৪টি বড় ভূমিকম্প হয়েছে। এগুলোর মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৬ থেকে ৮ দশমিক ৬ মাত্রার। ৮ দশমিক ১ মাত্রার হয়েছে ১৮৯৭ সালে, যার উৎপত্তি ছিল ভারতে। এরপর ১৯৫০ সালের ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিও ভারতের আসামে। এ ছাড়া মিয়ানমার, ভুটান, নেপালের ভূকম্পনের ঢেউও এসে পড়ে বাংলাদেশে।

ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু অংশ উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। 

ঢাকার একটি অংশ, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিছু অংশ মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে৷

অন্যদিকে খুলনা ও বরিশাল বিভাগকে কম ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।

বড় ভূকম্পনের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষক কেন্দ্রের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা বলেন, একটি ভূমিকম্প হলে সেটা বড় ভূমিকম্পের আফটার শক হয়। আবার বড় ভূমিকম্পের আগেও ছোট ভূমিকম্প হতে পারে। কতদিন পর হবে বা কতবার হবে তার কোনো ধারণা পাওয়া যায় না।

মাধবদীর ভূকম্পনটি মাঝারি ধরনের ছিল উল্লেখ করে তিনি জানান, ১৯১৮ সালের পর দেশের ভেতরে এটা সবচেয়ে বড় শক হলো। সে সময় শ্রীমঙ্গলে ওই ভূকম্পনটি ছিল ৭ দশমিক ৬ মাত্রা। সে সময় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

তিনি বলেন, ১০০ বছর বা ১৫০ বছর পরপর বড় ভূমিকম্প হয়। সেটার দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছি আমরা। যেহেতু শত বছর আগে ডাউকি ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ভূমিকম্পের আগাম বার্তা পাওয়ার কোনো প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কার হয়নি। যদি হতো তবে আমরা সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে শিখে আসতে পারতাম। পৃথিবীর কোনো দেশই এই দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, আগে থেকে জেনে।

ব্যতিক্রম জাপান, প্রয়োজন উদ্যোগ
পৃথিবীর সবচেয়ে ভূকম্পন বেশি যে দেশগুলোতে হয় তার মধ্যে অন্যতম জাপান। তাই জাতিগতভাবে তারা এটি অন্যদের চেয়ে ক্ষতি বেশি কমাতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। সে ব্যবস্থা অন্যরাও অনুকরণ করতে পারে।

ফারজানা সুলতানা বলেন, ভূকম্পনের প্রি ওয়েব রিসিভ করা যায়। ওটা সেটা করে সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুতের মতো পরিসেবাগুলো বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া ব্লিডিং কোড মেনে ওরা ভবন তৈরি করে৷ ফলে বড় ভূমিকম্প হলেও ক্ষতি কম হয়। তাই সহনশীল করে ভবন তৈরি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আনসারী এ বিষয়ে বলেন, ৭ মাত্রার ভূমকম্পনগুলো ১০০ থেকে ১২৫ বছর পরপর হয়। আর ৮ মাত্রারগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পরপর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাধবদীর ভূকম্পনে ঢাকার অনেক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিল্ডিং কোড না মানায় এমন হয়েছে৷ 

ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৩৫ শতাংশের মতো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ তাই ২১ লাখের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পরীক্ষা করা উচিত। এ ছাড়া রাজউকের মাধ্যমে ভবন পরীক্ষা করে ভবন মালিকদের জবাবদিহিতায় আনা দরকার।

ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর বলেন, ১০০ বছরের মধ্যে দেশের ভেতরে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পনগুলোর মধ্যে সব বেশি মাত্রার ভূকম্পন হলো মাধবদীতে। এটাই সর্বোচ্চ। কাজেই এখনই সতর্ক হওয়া উচিত।

সচেতনতা ও প্রস্তুতি ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এক প্রতিবেদনে বলেছে, ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের দিক থেকে ঝুঁকিপ্রবণ এক জনপদ বাংলাদেশ। ভূমিকম্প জীবন নেয় না; জীবন নেয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা। ভূমিকম্পে ঘরের দেয়াল কিংবা ছাদ ধসে পড়ে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস হয়, আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিকম্পে করণীয় সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে জীবনহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি আরও বেড়ে যায়। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর ব্যবস্থা তাই নিজেদেরই গ্রহণ করতে হবে।

ভূকম্পনের সময় করণীয়
ভূকম্পন অনুভূত হলে শান্ত থাকতে হবে। আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করা যাবে না কিংবা তাৎক্ষণিকভাবে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে না। ভূমিকম্পের সময় বিছানায় থাকলে, বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে নিতে; অতঃপর টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোনো আসবাবের নিচে আশ্রয় নিতে হবে এবং তা এমনভাবে ধরে থাকতে হবে যেন মাথার ওপর থেকে সরে না যায়। এ ছাড়া শক্ত দরজার চৌকাঠের নিচে ও পিলারের পাশে আশ্রয় নিতে হবে।

বারান্দা, ব্যালকনি, জানালা, বুকশেলফ, আলমারি, কাঠের আসবাবপত্র, বাঁধানো ছবি বা অন্য কোনো ঝুলন্ত ভারি বস্তু থেকে দূরে থাকতে হবে৷ রান্নাঘরে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে আসতে হবে। বন্ধ করতে হবে বাড়ির গ্যাস, বিদ্যুতের মূল সংযোগ। লিফট ব্যবহার করা যাবে না। 

ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে খোলাস্থানে আশ্রয় নিতে হবে। জনাকীর্ণ ঘরে (যেমন- গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, সিনেমা হল, মার্কেট) থাকলে বাইরে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি করা যাবে না।

পণ্য সামগ্রীর শেলফ থেকে দূরে থাকতে হবে এবং দু-হাতে মাথা ঢেকে বসে পড়তে হবে। গাড়িতে থাকলে ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে গাড়ি থামাতে হবে। ভূকম্পন না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভেতর থেকে বের হওয়া যাবে না। ভাঙা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়া-চড়ার চেষ্টা না করে চুপচাপ থাকতে হবে।

একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হতে পারে। তাই প্রথমবার অনুভূত কম্পন থেমে যাওয়ার পর ঘর থেকে সিঁড়ি দিয়ে সারিবদ্ধভাবে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে।

ভূমিকম্প মোকাবিলায় নিজেকেই প্রস্তুতি রাখতে হবে
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ওই প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাড়ি নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোড মেনে চলতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের সংযোগ ঝুঁকিমুক্ত কি-না তা নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে এবং তা কীভাবে বন্ধ করতে হয় তা সবাইকে জানিয়ে রাখতে হবে।

ঘরের ভারি আসবাবপত্র (যেমন- আলমারি, শেলফ, ফুলের টব, ছবির ফ্রেম ইত্যাদি) যাতে ভূমিকম্পে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা না ঘটাতে পারে, সেজন্য যথাসম্ভব পেছন থেকে আংটা লাগিয়ে দেয়ালের সঙ্গে আটকিয়ে রাখলে ক্ষতি কম হবে।

বহুতল ভবন/মার্কেট/হোটেল/বিদ্যালয়ের সিঁড়ি প্রশস্তকরণ ও ব্যবস্থা রাখতে হবে জরুরি দরজা ও সিঁড়ির। ভূমিকম্পকালীন আত্মরক্ষার স্বার্থে ঘরে সবসময়ের জন্য রেডিও, টর্চ লাইট, হাতুড়ি, হেলমেট, কুড়াল ও প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জামসমূহ একটি ব্যাগে মজুত রাখতে হবে।


   আরও সংবাদ