ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৯ অগাস্ট, ২০২৫ ১৪:৫৫ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪১৮ বার
“যদি আইন সবার জন্য সমান না হয়, তবে অপরাধ করার সাহস রাষ্ট্রই দেয়।”-হান ফেই, চীনা দার্শনিক।
রাষ্ট্র -যে প্রতিষ্ঠানকে আমরা ন্যায়বিচারের রক্ষক, দুর্বলের আশ্রয় বলে মনে করি — কখনো কখনো নিজেই সেই আশ্রয়ের জায়গায় বিষবৃক্ষ হয়ে ওঠে। যখন আইন, নীতি ও প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী ও সৎ থাকে, তখন সমাজে আস্থা বাড়ে এবং অপরাধ কমে। কিন্তু আইন যদি পক্ষপাতপূর্ণ হয়, বিচারহীনতা ঘনিয়ে উঠলে বা কর্তৃত্বের অপব্যবহার ঘটে—তবে রাষ্ট্রই অনিচ্ছাকৃতভাবে অপরাধে ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিষয়টি শুধু তাত্ত্বিক নয়; আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক রিপোর্ট ও বাস্তব জীবনের নানা ঘটনার আলোয় এ ধারণা শক্তিশালীভাবে প্রমাণিত।
ধর্ম ও দর্শনে রাষ্ট্রের ন্যায়পরায়ণতার কথা বারবার বলা হয়েছে। কুরআন, বাইবেল, বৌদ্ধ ও হিন্দু গ্রন্থে প্রশাসনের ন্যায়প্রধান হওয়া—শাসক-শাসিতের মধ্যে ন্যায্যতা বজায় রাখাই রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ আছে। ইসলামিক নীতিতে বিচারকে “আল্লাহর আদেশ” বলা হয়েছে; খ্রিস্টীয় ও বৌদ্ধ দর্শনে শাসক যদি অবিচার করে, সমাজ ভেঙে পড়ে—এমন সতর্কবার্তাও আছে। ধর্মীয় দর্শন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—রাষ্ট্র কেবল শক্তি নয়; এর নৈতিক কর্তব্য মানুষকে সুরক্ষিত রাখা। (ধর্মীয় পাঠ্য ও তাত্ত্বিক ঐতিহ্যসূত্র)।
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুরখেইম দেখেছিলেন, অপরাধ সামাজিক অনিবার্যতা হলেও—যদি সামাজিক নিয়ম-মানদণ্ড দুর্বল হয় বা বিভাজিত হয় (anomie), তখন অপরাধ বাড়ে। রবার্ট মার্টনের Strain Theory বলে—যখন সমাজের কাঠামো বৈধ উপায়ে সবার কাছে সুযোগ না জানায়, তখন মানুষের মধ্যে চরম মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় এবং অনেকে অবৈধ পথ ধরতে পারে। এই তত্ত্বগুলো বোঝায়—কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা (চাকরি, শিক্ষা, ন্যায্য সুযোগের অভাব; নীতির দ্বৈতমান) সমাজে অপরাধের “চাষের জমি” তৈরি করে।
আন্তর্জাতিক প্রমাণ: রাষ্ট্রীয় আচরণ এবং অপরাধ—বিশ্বের অভিজ্ঞতা
বিশ্ব-স্তরে সহিংসতা ও অপরাধের মাত্রা
ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (UNODC)–র বিশ্ব হোমিসাইড রিপোর্ট ו তথ্য দেখায় যে, বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতার ধরণ ভিন্ন—কিন্তু যেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, শাসনব্যবস্থা ও ন্যায্য আইন প্রয়োগ দুর্বল, সেখানে ঘন ঘন সহিংসতা ও অপরাধ বেশি দেখা যায়। এই আন্তর্জাতিক ডেটা রাষ্ট্রের কার্যকারিতা ও অপরাধের ঘনত্বের মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে সহায়ক।
ব্রাজিল — পুলিশের বর্বরতা ও আস্থা হ্রাস
ব্রাজিলে পুলিশি হত্যাকাণ্ড ও রেড-রুম অভিযানের রিপোর্ট দেখায়, একদিকে অপরাধী গ্যাং সক্রিয়—অন্যদিকে পুলিশের কড়া অভিযান প্রায়ই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, যা সম্প্রদায়ের মধ্যে পুলিশে আস্থা ভাঙায় এবং অপরাধের পুনরাবৃত্তি বাড়ে। মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘ-অভিজ্ঞ রিপোর্টগুলো এ ধরনের প্যাটার্ন তুলে ধরেছে।
যুক্তরাষ্ট্র — বর্ণভিত্তিক পুলিশি সহিংসতা ও জবাবদিহি
জর্জ ফ্লয়েড ও টায়র নিকোলসের মতো ঘটনায় দেখা গেছে কিভাবে পুলিশের নির্যাতন জাতিগত-অবিচারের সাথে জড়িয়ে আছে; আর ‘qualified immunity’ ইত্যাদি নীতিমালা রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দায়বদ্ধতা কঠিন করে দেয়। সেইসঙ্গে বিক্ষোভ ও আইনি লড়াইয়ের ফলস্বরূপ কিছু স্থানীয় সংস্কার সম্ভব হলেও, ব্যাপক ও স্থায়ী সংস্কার জাতীয় স্তরে ধীরগতিতে অগ্রসর হয়েছে।
ভারত ও দিল্লি: পুলিশের পক্ষপাত ও জনআস্থা
২০২০ দিল্লি হিংসার পর পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মানবাধিকার সংস্থার সমালোচনা উঠে—যা জনতায় রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারে আস্থা ক্ষুণ্ন করেছে। এ ধরনের ঘটনা মানুষের মধ্যে ধারণা জাগায় যে, আইন ও বাস্তবতার মধ্যে ফাঁক রয়ে গেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা ও ‘স্টেট ক্যাপচার’
দক্ষিণ আফ্রিকার জাণ্ডা/জান্ডা-সমূহের সময়কালে দেখা যায় কিভাবে রাজনৈতিক দুর্নীতি, নিযুক্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহার রাষ্ট্রীয় কৌশলে অপরাধকেই পুষ্ট করে—এর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও কমিশন চালালেও, ক্ষত এখনও ভরেনি।
ব্যক্তিগত গল্প: তামিম—আইন, মানবতা ও সমাজের ভাঙন
তামিমের কাহিনি (একটি সত্যঘটিত অনুপ্রাণিত গল্প) আমাদের মনে করায়—অপরাধী শুধু ‘অপরাধী’ নয়; তার পেছনে অনাহার, সামাজিক অবহেলা, চিকিৎসা সংকট, বা পারিবারিক ভাঙন—এসব মানবিক কাহিনি লুকিয়ে থাকে। সামাজিক নিরাপত্তার গর্তগুলো যখন বড় হয়, তখন অনেকেই অল্পকিছু চুরি করে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়; আবার তাদের ওপর কঠোর শাস্তি আর পুনর্বাসনের অভাব সমাজকে আরও দুর্দশাগ্রস্ত করে। গবেষণা দেখায়—কিশোর অপরাধীদের অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক-আর্থিক চাপ ও অভাব-অসহায়তা তার মূল কারণ।
আধুনিক সমাধান: গবেষণা ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে করণীয়
১) নীতিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি — স্বাধীন তদন্ত, নিরপেক্ষ আদালত ও শক্তিশালী তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান অপরিহার্য; UNODC–র ডেটা ও রিপোর্ট থেকে এটা স্পষ্ট যে, স্বচ্ছতা সহিংসতা কমায়।
২) রেস্টোরেটিভ জাস্টিস (Restorative Justice) — ভুক্তভোগী ও অপরাধীর মুখোমুখি সংলাপ ও পুনর্বাসন পদ্ধতি সফল মডেল হিসেবে বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে; ইউরোপীয় ও কনটিনেন্টাল গবেষণায় এর ইতিবাচক প্রভাব নথিভুক্ত আছে।
৩) মানসিক ও সামাজিক মূল্যায়ন বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধ্যতামূলক করা — কিশোর অপরাধীর ক্ষেত্রে পুনর্বাসন-ভিত্তিক বিচার অধিক ফলপ্রসূ; জার্মানি, কানাডার মতো দেশে সামাজিক মূল্যায়ন কার্যকর। (জাতীয় আইন-অভিজ্ঞতা)
৪) গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের তদারকি — স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটি রাষ্ট্রীয় অস্বচ্ছতা উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতীয় কেসে মিলিত অভিজ্ঞতা দেখা যায়।
৫) নীতিগত পুনর্গঠন — প্রশিক্ষিত পুলিশ, নৈতিক শিক্ষা, দুর্নীতিবিরোধী আইনগত কাঠামো—এগুলো রাষ্ট্রকে অপরাধ-উৎপাদনশীল এলাকার পরিবর্তে অপরাধনাশক সংস্থায় পরিণত করবে। (ক্রিমিনোলজি ও সরকারি নীতি গবেষণা)
নৈতিক বিবেচনা: শেষ প্রশ্নটি আবারও
রাষ্ট্র যদি ন্যায়বিচার কেটে-ছেঁটে প্রয়োগ করে—অর্থাৎ আইন যদি শক্তি-ভিত্তিক হয়, পক্ষপাতশীল হয়—তবে অপরাধীর ছায়া বাড়ে। তখন প্রশ্ন জাগে—অপরাধী আসলে কে? কেবল সেই ব্যক্তি নাকি সেই প্রতিষ্ঠানও, যা অপরাধের কারণ হস্তক্ষেপ করে বা আইনকে প্রহসন বানায়? রাষ্ট্র যদি মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়, তার অংশগ্রহণ অনায়াসেই অপরাধের উৎপাদনশীল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, অপরাধ শুধুই ব্যক্তিগত ব্যাধি নয়—এটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার ফল।
সংক্ষিপ্ত উপসংহার (প্রস্তাবিত নীতিসমূহ)
রাষ্ট্রের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে স্বাধীন তদন্ত ও অংশগ্রহণমূলক তত্ত্বাবধান গুরুত্বপূর্ন।
পুনর্বাসনভিত্তিক ন্যায়বিচার (restorative justice) ও কমিউনিটি-ভিত্তিক পুনর্গঠন অপরাধ কমাতে প্রমাণভিত্তিক কার্যকর।
• সাহিত্য, ধর্ম ও দার্শনিক চিন্তা আমাদের মনে করায়—ন্যায় কেবল আইন নয়, এটি মানুষের মর্যাদা ও সহমর্যাদার প্রতিফলন।