ঢাকা, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

ন্যায়বিচারের মুখোশে প্রতিশোধ: রাষ্ট্র কাকে রক্ষা করছে? : এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ২৫ অগাস্ট, ২০২৫ ১৯:৩৫ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪০৬ বার


ন্যায়বিচারের মুখোশে প্রতিশোধ: রাষ্ট্র কাকে রক্ষা করছে? : এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর

একটি ছোট্ট কক্ষ। জানালা নেই। আলো নেই। শুধু এক কোণে লোহার শিক। গুয়ারানতানামো বে-র এক বন্দী একদিন লিখেছিলেন, “আমি জানি না, আমি কী অপরাধ করেছি। শুধু জানি, আমি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিলাম।” তার জীবনের সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়েছিল—কিন্তু আদালতের সামনে দাঁড়াবার ন্যূনতম অধিকারও দেওয়া হয়নি। প্রশ্নটা তখন শুধু একজন মানুষের নয়; প্রশ্নটা রাষ্ট্রের: ন্যায়বিচার করছে, না প্রতিশোধ নিচ্ছে?

বিচারের ছদ্মবেশে প্রতিশোধ
রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব ন্যায়বিচার। কিন্তু ইতিহাস বলে, বহু রাষ্ট্র বিচারের নামে আসলে প্রতিশোধই নিয়েছে। ব্রিটিশরা বিপ্লবীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। তুরস্ক অভ্যুত্থানের পর হাজারো বিচারক ও সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করেছে। বাংলাদেশে সমালোচক লেখক–সাংবাদিককে “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন” দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন উঠে আসে: রাষ্ট্র কি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করছে, নাকি ভয় সৃষ্টি করছে?

প্রতিশোধের যন্ত্র: আইনের অপব্যবহার
প্রতিশোধ যখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়, তখন দেখা যায়—
ক) বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রেখে হয়রানি।
খ) হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু।
গ) জামিন বাতিল ও মিথ্যা মামলা।
ঘ) বিশেষ আইনকে শাস্তির হাতিয়ার বানানো।
এ সবই রাষ্ট্রকে আইনরক্ষক নয়, প্রতিশোধপরায়ণ শাসকে রূপান্তর করে।

বিচার বনাম প্রতিশোধ
বিচার    প্রতিশোধ
প্রমাণ ও ন্যায়ের ভিত্তি    আবেগ ও শক্তির প্রদর্শন
মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল    অধিকারের লঙ্ঘন
নৈতিকতার প্রতিফলন    অমানবিকতার প্রতিচ্ছবি
সংস্কারমুখী    দমনমুখী
এই টেবিলটাই বলে দেয়—রাষ্ট্র আসলে কোন পথে হাঁটছে।

দর্শন, সাহিত্য ও ধর্মের কণ্ঠ
এরিস্টটল বলেছিলেন: “ন্যায় মানে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য দেওয়া।” প্রতিশোধ সেই প্রাপ্য কেড়ে নেয়।
দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেন: “বিচার আদালতে নয়, মানুষের বিবেকে।” বিবেকহীন রাষ্ট্র ন্যায় আনতে পারে না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন—ক্ষমতাবানরা আইনকে কিভাবে বাঁকায়।
বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন: “আইন যদি শ্রেণির পক্ষে দাঁড়ায়, তবে তা আইন নয়, নিপীড়নের যন্ত্র।”
ধর্মও একই কথা বলে: কোরআন: “অন্যায়কে অন্যায় দিয়ে প্রতিহত কোরো না।” 
বাইবেল: “Vengeance is mine, says the Lord।”
গীতা: ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ, প্রতিশোধের জন্য নয়।

মানুষ কেন আইন হার মানে?
ভারত: নিম্ন আদালতে আস্থা মাত্র ৩৫–৪০%।
যুক্তরাষ্ট্র: সুপ্রিম কোর্টের আস্থা এক দশকে ৭০% থেকে নেমে ৪৮%।
বাংলাদেশ: ৮৯% মানুষ মনে করেন, বিচার পেতে ঘুষ লাগে।
ফলে মানুষ আইনের বদলে “দল”, “পরিচিতি” বা “গ্রাম্য সালিশ”-এ ভরসা করে। ২০২২ সালে ঢাকার আশুলিয়ায় এক শ্রমিককে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, কারণ মানুষ বিশ্বাস করেছিল—পুলিশে দিলে বিচার হবে না।

রাষ্ট্র যখন প্রতিশোধপরায়ণ হয়
প্রতিশোধের ফল কখনো টেকসই হয় না।
•    আইনের প্রতি আস্থা ভেঙে পড়ে।
•    বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
•    ভয় ও ক্রোধে সমাজ অস্থিতিশীল হয়।
•    আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ধ্বসে যায়।
ইতিহাস সাক্ষী: যে রাষ্ট্র প্রতিশোধের খেলায় মাতে, তার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সমাধান: শক্তি নয়, নৈতিকতার রাজনীতি
•    বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন ও স্বচ্ছ করা।
•    আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানা।
•    প্রতিশোধমূলক মামলার বিরুদ্ধে সুরক্ষা তৈরি।
•    প্রযুক্তিকে স্বচ্ছতার হাতিয়ার করা।
•    জনগণকে বোঝানো: বিচার প্রতিহিংসার চেয়ে শক্তিশালী।

পরিশেষে এটুকু বলা যায়-রাষ্ট্র যদি ন্যায়বিচারের বদলে প্রতিশোধের পথে হাঁটে, তবে সেটি গণতান্ত্রিক নয়, বরং শাসকের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার খেলা। ন্যায়বিচার রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি—কারণ প্রতিহিংসা টিকে না, ন্যায় টিকে থাকে।

এম.এ. এ. বাদশাহ্ আলমগীর 
Advocate 
The Subordinate Courts of Bangladesh
Associated with Practice at the High Court 
Legal Advisor, Apradhchokh24.com
badshah.alamgir08@gmail.com 


   আরও সংবাদ