ঢাকা, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

আইনের দাঁড়িপাল্লা কি সত্যিই সবার জন‍্য সমান?: অ্যাডভোকেট এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১৪ অগাস্ট, ২০২৫ ১০:০৪ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৬২১ বার


আইনের দাঁড়িপাল্লা কি সত্যিই সবার জন‍্য সমান?: অ্যাডভোকেট এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর

আদালতের ভেতর যেন এক অদৃশ্য চাপা উত্তেজনা। দেয়ালে ঝুলছে সংবিধানের ফ্রেম করা প্রতিশ্রুতি—“সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান।” কাঠের বেঞ্চের একপাশে বসে আছেন শফিক মিয়া—রিকশাচালক, হাতে মলিন কাগজের ফাইল, চোখে ভয় ও অনিশ্চয়তা। অন্য পাশে স্যুট-টাই পরা এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, পাশে তিনজন অভিজ্ঞ উকিল, হাতে দামি ফোন, ঠোঁটে নিশ্চিন্ত হাসি। অভিযোগ? দুজনের বিরুদ্ধেই একই ধরণের অপরাধের মামলা। কিন্তু আদালতের বাতাস যেন শুরু থেকেই ধনীর পক্ষে ঝুঁকে আছে।

স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা
হামুরাবির বিধান, ম্যাগনা কার্টা, ফরাসি বিপ্লব কিংবা কুরআনের আয়াত—সবখানেই ন্যায়বিচারের মূলনীতি এক: আইনের নিচে সবাই সমান। কিন্তু বাস্তবে এই সমতা উন্নয়নশীল দেশের আদালতে প্রায়ই ধুলো জমা স্বপ্নে রূপ নেয়। বাংলাদেশে আয়বৈষম্য, রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতা মিলিয়ে ধনী-গরিবের জন্য আইন যেন দুই ভিন্ন মুখোশ পরে।

গরিবের জন্য আদালত কেন দূর পাহাড়
দরিদ্র মানুষের জন্য ন্যায়ের পথে রয়েছে তিনটি উঁচু পাহাড়—
১. টাকা — মামলা ফাইল ফি, উকিলের পারিশ্রমিক, সাক্ষীর খরচ।
২. সময় — মাসের পর মাস তারিখ, বছরের পর বছর শুনানি।
৩. প্রভাব — ক্ষমতাবানদের রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাব বিচারকে তাদের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।
ধনীরা এই তিন পাহাড় পেরোয় গাড়িতে চড়ে। গরিবেরা ওঠে খালি পায়ে।

রিমান্ড বনাম জামিন: বৈষম্যের খোলা চিত্র
বাংলাদেশে বহু গরিব আসামি মাসের পর মাস বিনা বিচারে কারাগারে পড়ে থাকে—কারণ জামিন ফাইল করার খরচ তাদের নাগালের বাইরে। অপরদিকে ধনী আসামি একই অপরাধে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মুক্তি পায়। এ বৈষম্য কেবল বাংলাদেশের নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বেইল সিস্টেমে একই অবস্থা (Heaton, Mayson & Stevenson, 2017)—গরিবরা উচ্চ বেইল দিতে না পেরে আটক থাকে। তবে সেখানে কমিউনিটি বেইল ও প্রি-ট্রায়াল সার্ভিসেস চালু করে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে।

বিশ্বের আয়না
যুক্তরাজ্য: Legal Aid, Sentencing and Punishment of Offenders Act (2012) দরিদ্রদের জন্য কিছু আইনি সহায়তা রেখেছে।
সুইডেন: প্রায় সব ক্ষেত্রে সরকারি খরচে আইনি সেবা—সমতার এক জীবন্ত উদাহরণ।
ভারত: ন্যাশনাল লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি (NLSA) ফ্রি লিগ্যাল এইড দেয়, তবে সেবার পরিধি সীমিত।

ইতিহাস ও ধর্মের সতর্কবার্তা
ইসলাম: নবী মুহাম্মদ (সা.) সতর্ক করেছেন—ক্ষমতাবানকে রেহাই দিয়ে দুর্বলকে শাস্তি দেওয়া জাতিকে ধ্বংস ডেকে আনে।
ফরাসি বিপ্লব: সমতার পতাকা উড়লেও দরিদ্ররা ন্যায় ও জীবিকার অভাবে রয়ে গিয়েছিল বঞ্চিত।
বিজ্ঞান: সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বুরদিয়ু দেখিয়েছেন—আইনের কাঠামো প্রায়শই ক্ষমতাবান শ্রেণির স্বার্থে তৈরি।

কেস স্টাডি: তাজরীন ফ্যাশনের শ্রমিকরা
২০১৩ সালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানি। ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচারের জন্য মামলা করেও শ্রমিকরা বছরের পর বছর অপেক্ষায়। Human Rights Watch (2019) জানায়—প্রভাবশালী মালিকপক্ষ চাপ দিয়ে মামলার সমাপ্তি ঘটায়, আর গরিব শ্রমিকরা আইনি সহায়তার অভাবে ন্যায়বিচার পায়নি।

শেষ দৃশ্য
বিচারক কক্ষে শফিক মিয়া এখনও বসে আছে—তার উকিল আসেননি, কারণ বকেয়া ফি শোধ হয়নি। অন্যদিকে ধনী আসামি জামিনের কাগজ হাতে নিয়ে আদালতের দরজা পেরিয়ে যাচ্ছে। আইনের বইয়ে তারা দুজন সমান। কিন্তু আদালতের মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে এক অদৃশ্য প্রাচীর—যার নাম অর্থ ও ক্ষমতা। যদি এই প্রাচীর ভাঙা না যায়, তবে সংবিধানের ফ্রেমে ঝুলে থাকা প্রতিশ্রুতি একদিন শুধুই ইতিহাসের ধুলোমাখা স্লোগান হয়ে থাকবে।


   আরও সংবাদ