ঢাকা, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

রাজনীতি ও বিচার: স্বাধীনতা নাকি বন্দিত্ব? : এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১৬ অগাস্ট, ২০২৫ ১৭:১৩ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৬৩৮ বার


রাজনীতি ও বিচার: স্বাধীনতা নাকি বন্দিত্ব? : এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর

আদালতের ভেতরে রাষ্ট্রের হাত: আদালতের বেঞ্চে অসমতা
ঢাকার আদালতকক্ষে এক বিকেল।রিকশাচালক শফিক মিয়া—ফি বাকি থাকায় উকিল আসেননি। অন্যদিকে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী—তিন আইনজীবী, প্রস্তুত জামিন। কাগজে দুজন সমান। কক্ষে তারা দুই ভুবনের মানুষ।

ইতিহাসের শৃঙ্খল
সংবিধান বলেছে—“সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান।” কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এ সমতা কাগজেই বন্দি। Masdar Hossain মামলা (১৯৯৯): সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল নিম্ন আদালতকে নির্বাহী থেকে আলাদা করতে। কিন্তু রাজনৈতিক অনীহা সেই রায়কে অর্ধেক মৃত করে রেখেছে।

বিচারপতি নিয়োগ: কে বসায় কাকে?
বাংলাদেশে বিচারপতি নিয়োগ অনেকাংশে সরকারের হাতে।
২০১৪: ১৬তম সংশোধনী আদালতকে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা দেয়।
২০১৭: সুপ্রিম কোর্ট সেটি বাতিল করে।
এখনো কোনো স্বাধীন Judicial Appointments Council নেই।

অন্যরা কী করছে?
ভারত: বিচারপতিরা নিজেরাই বাছাই করেন (কোলিজিয়াম সিস্টেম)।
যুক্তরাষ্ট্র: রাজনৈতিক নিয়োগ, তবে সিনেট শুনানি ও মিডিয়া নজরদারি।
সুইডেন: স্বাধীন কমিশন বাছাই করে। বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়াগুলো অনুপস্থিত।

রাজনৈতিক মামলা: ন্যায় নাকি অস্ত্র?
বাংলাদেশে মামলা প্রায়শই রাজনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার। বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ নেতারা আসামি। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি নেতারা আসামি।
২০০৭: তত্ত্বাবধায়ক সরকার—সব বড় নেতা মামলায় জড়িয়ে পড়েন।
তাজরীন ট্র্যাজেডি (২০১৩): শ্রমিকদের মামলা ঝুলে থাকে, মালিকপক্ষ দায়মুক্তি পায়। আইন এক নয় সবার জন্য।

জামিন বনাম রিমান্ড
বাংলাদেশের কারাগারে হাজারো গরিব মানুষ জামিনের টাকা না দিতে পেরে আটক। একই দিনে প্রভাবশালী আসামি জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক আয়না:
যুক্তরাষ্ট্রেও একই সমস্যা। (Heaton, Mayson & Stevenson, 2017), তবে সেখানে Bail Reform ও Community Bail Fund শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে কোনো বিকল্প নেই।

দুর্নীতি ও আস্থা সংকট
Transparency International (2021): আদালতের সঙ্গে যুক্ত ৫৬.৮% মানুষ দুর্নীতির অভিজ্ঞতা জানায়।
World Justice Project (2022): Rule of Law Index-এ বাংলাদেশ ১৩৯ দেশের মধ্যে ১২৭তম। এই সংখ্যাগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়। এগুলো বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ার প্রমাণ।

নৈতিকতার আয়না
প্লেটো বলেছিলেন—ন্যায় মানে দুর্বলকে রক্ষা করা। বাস্তবে দুর্বলরাই সবচেয়ে কম সুরক্ষা পান। হাদিসে নবী (সা.) সতর্ক করেছেন—“যে জাতি দুর্বলকে শাস্তি দিয়ে শক্তিশালীকে ছাড় দেয়, সেই জাতি ধ্বংস হয়।”বুরদিয়ু দেখিয়েছেন—আইন প্রায়ই ক্ষমতাবান শ্রেণির স্বার্থে গড়ে ওঠে। অতএব, আদালতে রাজনীতির প্রভাব শুধু আইনি নয়—নৈতিক ব্যর্থতাও।

বিশ্ব থেকে শিক্ষা
যুক্তরাজ্য: দরিদ্রদের জন্য Legal Aid।
সুইডেন: রাষ্ট্র প্রায় সব আসামিকে আইনি সহায়তা দেয়।
ভারত: NALSA ফ্রি লিগ্যাল এইড দেয়। বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা কার্যত নেই। গরিবদের কাছে আদালত তাই “দূরের পাহাড়।”

কেস স্টাডি: ICT বিতর্ক
২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ফাঁস হয়। এটি প্রকাশ করে—বিচারে রাজনৈতিক চাপ ঢুকে গেছে।
ফলে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

সংস্কারের পথ
বিচারব্যবস্থাকে বাঁচাতে দরকার—
১. স্বাধীন Judicial Appointment Commission
২. দরিদ্রদের জন্য আইনি সহায়তা তহবিল
৩. ডিজিটাল কোর্ট ও স্বচ্ছ কেস ম্যানেজমেন্ট
৪. রাজনৈতিক মামলা সংস্কৃতি বন্ধ করা
৫. আদালত প্রশাসন নির্বাহীর বাইরে আনা

শেষ দৃশ্য
শফিক মিয়া এখনো কাঠের বেঞ্চে বসে আছেন। তার মামলা ঝুলছে, উকিল আসেনি। অন্যদিকে প্রভাবশালী আসামি জামিন হাতে বেরিয়ে গেছে। কাগজে তারা সমান নাগরিক। বাস্তবে দেয়াল—অর্থ ও ক্ষমতার প্রাচীর।

রাষ্ট্রের সামনে প্রশ্ন
ন্যায়বিচার মানে শুধু রায় নয়—এটা জনগণের আস্থা। যদি মানুষ বিশ্বাস হারায়, আদালত তাদের রক্ষা করবে না—তাহলে রাষ্ট্রের ভিত্তিই নড়ে যাবে। বাংলাদেশ কি সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে? নাকি আদালত থেকে জনগণের বিশ্বাস চিরতরে বিদায় নেবে?

লেখক
Advocate 
The Subordinate Courts of Bangladesh
Associated with Practice at the High Court 
Legal Advisor, Apradhchokh24.com
badshah.alamgir08@gmail.com 


   আরও সংবাদ