ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৯ জুলাই, ২০২৫ ১৮:০৫ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৪৩ বার
এম.এ.এ.বাদশাহ্ আলমগীর
Advocate
The Subordinate Courts of Bangladesh
Associated with Practice at the High Court
রাত গভীর হলে, একটা শব্দও হয়ে ওঠে বজ্রসম। যেমন ‘ন্যায়’ শব্দটা। দিনের আলোয় আমরা যাকে খুঁজি খসখসে আইনপত্রে—রাতের নিস্তব্ধতায় সে হয়ে ওঠে এক ব্যর্থ প্রতিধ্বনি। কোথাও কোনও কাঁদতে থাকা চোখের ভিতর, কোনও অসহায় কণ্ঠের চুপচাপ আকুতিতে, কিংবা আদালতের বারান্দায় বসে থাকা এক পরিত্যক্ত জীবনের আর্তনাদে। প্রশ্ন জাগে—এই আইন, এই আদালত, এই সিস্টেম—আসলে কাকে প্রতিনিধিত্ব করে?
আইনের হাত আছে। চোখও আছে—তবে সেটা সেই অন্ধfold করা চোখ, যা কখনও ছিল ন্যায়ের প্রতীক।
কিন্তু কোথায় সেই মস্তিষ্ক, যেটা আইনকে করে তোলে অনুভবশীল? যে বিবেক, শুধু ধারা নয়, বোঝে জীবন। বোঝে কাঁদা চোখের ভাষা, শোনে অসহায়ের নীরব আর্তি।
আইন কি কেবল প্যারার ভাষা?
আমরা কি ন্যায় মানে বুঝি কেবল ‘আইনের প্যারা’?তবে সেই আইনের কোন পাতায় থাকবে গার্মেন্টসকর্মী মেয়েটির চোখের জল, যার ধর্ষণের পর বিচারপ্রক্রিয়া হয়ে ওঠে হয়রানির নামান্তর?
কোথায় থাকবে সেই বৃদ্ধ কৃষকের দলিল, যিনি আদালতের জটিলতায় বুঝে উঠতেই পারেন না, জমিটা আজও তার কি না? আর কোথায় লেখা আছে রিকশাওয়ালার ক্ষয়িষ্ণু জীবনের হিসাব, যে চারবার হাজিরা দিতে গিয়ে হারিয়েছে চারদিনের আহার?
কেস স্টাডি: মো. শফিকুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র (বাংলাদেশ, ২০১৮)
শফিকুল—এক গরিব রিকশাচালক। একটা জমি সংক্রান্ত জাল দলিলে ভুলবশত তাকে অভিযুক্ত করে এক পুলিশ কনস্টেবল। পাঁচ বছর ধরে সে কোর্টে দৌড়ায়। ক্ষয়ে যায় তার আয়, শরীর, আত্মবিশ্বাস।
শেষ পর্যন্ত, আত্মহত্যার চেষ্টা করার পর বিচারক মামলা খারিজ করেন।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—কে ফিরিয়ে দেবে তার পাঁচটি বছর?এই কি তাহলে বিচার?
বিচার: অধিকার না বিলাসিতা?
আইনের মূল লক্ষ্য তো বলা হয় “to secure justice”—তবে সেই ন্যায়ের পথ এত পিচ্ছিল কেন?
UNDP Bangladesh Justice Survey 2022 বলছে—৬৩% মানুষ বিশ্বাস করে, তারা সঠিক বিচার পায় না। ৮৫% নারী মনে করে, আদালতে যাওয়া মানে হয়রানির শুরু।
আমেরিকার The Innocence Project এর মতো আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রমাণ করেছে— আইন তখনই ন্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে, যখন তার ভেতর থাকে মানবতা।
ধর্ম, সাহিত্য, দর্শন—সবাই একবাক্যে বলে
ইসলাম বলে: “আল্লাহ তোমাদের আদেশ দেন ন্যায়বিচার করতে।” (সূরা নিসা ৫৮)
প্লেটো বলেন: “Justice is giving each his due”
রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেন: “মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ”—
আর সেই বিশ্বাস হারায়, বিচার না পেলে।
আজ সেই বিশ্বাসটাই ভঙ্গুর হয়ে উঠছে।
আইনি কাঠামোর পচন ও প্রয়োজনীয় পুনর্গঠন
কেরানীগঞ্জের একটি জমি নিয়ে শতবর্ষ পুরনো মামলা—
১৯২৫ সাল থেকে দলিল, হেবা, বণ্টন, দখল সব ঠিকঠাক।
তবু ২০২৩ সালে একমাত্র প্রশ্ন—“মূল মালিক কে?”
একটি জমির গল্প দিয়ে বোঝানো যায়—এই দেশের আইনি কাঠামোতে কী পরিমাণ ধাঁধাঁ, কী পরিমাণ অনিশ্চয়তা।
আইন যদি হয় কেবল এক ধাঁধাঁ, তবে সাধারণ মানুষের ন্যায়ের আশা কোথায়?
তাহলে এখন করণীয় কী?
আমরা কি চুপ করে যাব?
না।
এটাই সময়—আইনের হাতে কেবল হাত বা চোখ নয়, একটি বিবেকবান মস্তিষ্ক গজিয়ে তোলার।
আইন যেন হয় অনুভবশীল, যেন বুঝতে শেখে—বিচার শুধু রায় নয়, একটি দায়িত্ব।
একটি উত্তর—আবেগের প্রতি, প্রশ্নের প্রতি, সমাজের প্রতি।
একটি চিঠি, বিবেকের নামে
এই লেখা কোনও আইনি নথি নয়।
এ এক প্রেমপত্র—তাদের জন্য যারা দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় বসে।
যারা ‘আইন’ শব্দটি শুনে কেঁপে ওঠে।
যারা আজও বিশ্বাস করে, ন্যায় একদিন ফিরবে।
আমরা কি সত্যিই ন্যায়ের সমাজে বাস করছি?
নাকি কেবল তার মুখোশে?
সময় এসেছে, মুখোশ ছিঁড়ে সত্যিকারের ন্যায় ফিরিয়ে আনার।
কারণ— আইনের হাত আছে, চোখও আছে।
এখন দরকার—একটা মস্তিষ্ক।
রেফারেন্স:
UNDP Bangladesh Justice Perception Survey, 2022
The Innocence Project, USA
Plato, The Republic
Qur’an, Surah An-Nisa 4:58
Rabindranath Tagore, Sanchayita
Bangladesh Supreme Court Case Files (2015–2023)