ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৬ জুলাই, ২০২৫ ১২:৪০ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৪৫ বার
“Every man is guilty of all the good he did not do.” — Voltaire. শিশুর প্রথম শব্দ কান্না, আর মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের শেষ আবেদন—"স্যার, বিচার চাই..." এই দুই মুহূর্তের মাঝে যে যাত্রা, সেটি থানার গেট আর আদালতের সিঁড়িতে এসে বারবার থেমে যায়। থানা ও আদালত — একদিকে রাষ্ট্রের আশ্রয়স্থল, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আতঙ্কের ছায়া। এ যেন সৃষ্টির দুটি হাত—যার এক হাত দিয়ে ন্যায় দেওয়ার কথা, আর অন্য হাতে রয়ে গেছে লোকালয় বিচ্ছিন্ন দূরত্বের শেকল।
“The law is reason free from passion.” — Aristotle. আইন কাগজে লেখা। ন্যায় মানুষের হৃদয়ে। কিন্তু যখন কাগজ আর হৃদয়ের মাঝখানে একটি শীতল কাঠামো দাঁড়িয়ে যায়, তখন আইনের চোখ থেকে ন্যায়ের জ্যোতি হারিয়ে যায়। Cognitive Psychology বলে, “ভয়ের উৎস যদি হয় অজানা ও শক্তিসম্পন্ন, তবে মানুষ পেছনে সরে যায়।” তাই থানায় গিয়ে মানুষ ভুলে যায় ভাষা, আদালতে গিয়ে ভুলে যায় নিজের অবস্থান। সিস্টেম যদি ভয়ের জিন সৃষ্টি করে, তবে জনগণ আর ন্যায়কে খুঁজে পায় না, খুঁজে পায়—দালাল, হয়রানি আর সময়ের নিষ্ঠুরতা।
সকল ধর্ম ও দর্শনে ন্যায়কে সুন্দর করে তুলে ধরা হয়েছে-“Let justice roll down like waters and righteousness like a mighty stream.” — Amos 5:24, The Bible. ইসলাম বলে—“সত্য বলো, নিজের বিপক্ষে হলেও।” হিন্দু দর্শনে ধর্ম মানে—“ন্যায় ও কৃতজ্ঞতার বাস্তবতা।” বৌদ্ধ বাণী—“নিজেকে যা ভালো লাগে, অন্যকে তা দাও—এটাই ন্যায়।” খ্রিষ্টধর্মে, যিশু ন্যায়কে বলেছেন—“ঈশ্বরের চেহারার প্রতিবিম্ব।”অথচ সমাজে? থানায় সত্য কাগজে ফেলে রাখতে হয়। আদালতে সত্য পুঞ্জিভূত হয়ে থাকে প্রক্রিয়ার ফাঁকিতে। “Injustice anywhere is a threat to justice everywhere.” — Martin Luther King Jr.
বিশ্বের বিখ্যাত লেখকরা সাহিত্যের আয়নায় রাষ্ট্রীয় আত্মজিজ্ঞাসা তুলে ধরেছেন ভয়ানকভাবে; “There is no worse tyranny than to force a man to pay for justice.” — Bertolt Brecht. কাজী নজরুল লিখেছিলেন— “এই আদালতে হৃদয়ের কোনো স্থান নেই।” সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন— “জেলখানা আর আদালতের গন্ধ একই—বদ্ধ, আত্মকেন্দ্রিক, ভয়ানক।” দস্তয়েভস্কি ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এ দেখিয়েছেন, নৈতিকতা ছাড়া আইন কেবল শাস্তি হতে পারে, ন্যায় নয়। অরহান পামুক বলেছিলেন— “মানুষ যখন ভয় পায়, তখন সে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। এটাই নিষ্ঠুরতার শুরু।”
ভয় ও বিভ্রান্তির সমাজতাত্ত্বিক বাস্তবতা
সূচক তথ্য (বাংলাদেশ) উৎস
আদালত বুঝতে পারেন না ৬৫% UNDP, 2019
থানায় ভয় বা হয়রানি ৭২% BLAST, 2023
দালালের মাধ্যমে সেবা ৬১% TIB, 2021
গড় মামলা নিষ্পত্তি সময় ৫-৭ বছর সুপ্রিম কোর্ট বার, 2022
ভারতে ২০১৮ সালে শুরু হয় Fast-Track Courts। কেনিয়ায়, Mobile Courts পাহাড়ি অঞ্চলে যায়। যুক্তরাজ্যে, শুরু হয় Plain Language Law Movement, কিন্তু বাংলাদেশে, আদালতের নাম শুনলেই সাধারণ মানুষ প্রথমে বলেন—“মামলায় কেউ ভালো থাকেনা!”
ক্ষমতা, ন্যায় ও সময়: এক অদ্ভুত সমীকরণ : “Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely.”— Lord Acton. একজন সচিব, একজন পুলিশ অফিসার, একজন সংসদ সদস্য—যখন পদে থাকেন, থানা ও আদালত যেন তাদের জন্য সাজানো মঞ্চ।কিন্তু অবসরের পর? তারা হয়ে যান আর দশজন সাধারণ মানুষ। একটি মামলার তারিখে তাদেরও দাঁড়াতে হয় কোর্টের গেটের সামনে—“স্যার, সময় দিলেন না কেন?” এই আত্মসচেতনতার জন্যই প্রয়োজন ব্যবস্থা নয়, বিবেকস্নাত রাষ্ট্র।
সমাধানের পথ: ভয় থেকে আস্থার দিকে
করণীয় প্রস্তাব
আইনি শিক্ষার সাধারণীকরণ পাঠ্যবইয়ে সহজ ভাষায় আইন যুক্তকরণ
কমিউনিটি পুলিশিং থানা হোক নাগরিক অংশীদারত্বের কেন্দ্র
e-Judiciary ভার্চুয়াল কোর্ট, অনলাইন কেস ট্র্যাকিং
গণমাধ্যমের ব্যবহার নাটক, সিনেমা ও রিপোর্টে সচেতনতা
দালাল নির্মূল থানার গেটে হেল্প ডেস্ক ও দালাল-প্রতিরোধ টিম
বিচার বিভাগের নৈতিক প্রশিক্ষণ Judicial empathy এবং “Court User Committees”
একদিন হয়ত আপনি, আমি—সবারই দরকার হবে ন্যায়ের আশ্রয় : আজ আপনি একজন বিচারপতি—মানুষ উঠে দাঁড়ায় আপনার সামনে। আজ আপনি একজন মন্ত্রী—থানায় গেলে পুলিশ ছুটে আসে। কিন্তু একদিন... আপনার মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে, আপনি আসবেন আদালতে—একটি জামিন বাতিল করাতে। আপনার ছেলে গুম হলে, যাবেন থানায়—একটি জিডি করাতে। তখন কাঁপবে আপনার হাত, যেমন কাঁপে আজ একটি গরিব রিকশাওয়ালার। তখন থামবে আপনার কণ্ঠ, যেমন থামে আজ একজন বুদ্ধিজীবীরও, যখন তিনি বিচার চান। “There may be times when we are powerless to prevent injustice, but there must never be a time when we fail to protest.” — Elie Wiesel
শেষ বার্তা: “রাষ্ট্র তখনই ন্যায়বান,যখন তার দরজা দরিদ্র ও দুর্বল মানুষের জন্যও খুলে থাকে।” থানা ও আদালত আমাদের শত্রু নয়। ভয় নয়—এরা হোক আমাদের আশ্রয়। আইন জানুন—ভয় কাটান—ন্যায় পান।
এম.এ. এ. বাদশাহ্ আলমগীর
Advocate
The Subordinate Courts of Bangladesh
Associated with Practice at the High Court
Legal Advisor, Apradhchokh24.com