ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২০ জুলাই, ২০২৫ ১০:৪১ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৭৩৩ বার
অপরাধের মুখোমুখি আয়নায় কার মুখ দেখা যায়? : জন্মের পরপরই কেউ ‘অপরাধী’ হয় না। একটি শিশু পৃথিবীতে আসে নিষ্পাপ, নির্দ্বিধায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশে তৈরি হয় নিয়ম, বাধা, চাপ, লোভ, অপমান, ক্ষুধা, অবহেলা আর এক অদৃশ্য কিন্তু নির্মম শৃঙ্খলের জাল। তখন প্রশ্ন জাগে—অপরাধ কি মানুষ নিজে করে, না সময় তাকে বাধ্য করে? রাষ্ট্র কি সত্যি একজন মা, না একজন নীরব সাক্ষী? সমাজ কি পথ দেখায়, না অন্ধ গলিতে ঠেলে দেয়?
মানুষ কি প্রকৃতিগতভাবে অপরাধপ্রবণ? :
ঐতিহাসিকভাবে সমাজবিজ্ঞানীরা দ্বিধায় ছিলেন। হাবস (Hobbes) বলেছিলেন, “মানুষ মানুষের নেকড়ে,” আবার রুশো (Rousseau) বলেছিলেন, “মানুষ জন্মগতভাবে নিখুঁত, সমাজ তাকে নষ্ট করে।” বিখ্যাত দার্শনিক জ্যাঁ-পল সার্ত্র বলেছিলেন:“মানুষ তার সময় ও পরিস্থিতির দায়ে যেই হয়, তার জন্য সে নিজেই দায়ী এবং সে নিজেই মুক্তির পথ খুঁজে নিতে পারে।” এভাবে আমরা বুঝি, অপরাধ একটা আচরণ – যা পরিবেশ, প্ররোচনা, অসহায়ত্ব, ক্ষোভ কিংবা প্রতিশোধের ফল। কিন্তু সেটা কি কেবল ব্যক্তির দোষ?
রাষ্ট্র: একজন নীরব দর্শক, না সক্রিয় অপরাধী?
রাষ্ট্র যখন খাদ্য দেয় না, শিক্ষা দেয় না, বিচার দেয় না, সম্মান দেয় না— রাষ্ট্র যখন শিশুদের হাতে বইয়ের বদলে বন্দুক, আর তরুণদের হাতে কাজের বদলে কামার্ত হতাশা তুলে দেয়—তখন সেই রাষ্ট্র কি শুধু ‘সিস্টেমে সমস্যা আছে’ বলে পার পেয়ে যেতে পারে? স্মরণ করি ভিক্টর হুগোর কথাঃ“একটি কারাগার নির্মাণের আগেই একটি স্কুল তৈরি করুন, নইলে ভবিষ্যতে অপরাধী তৈরি হবে আপনার নীরবতায়।”
সময়: কি তবে অপরাধের প্রকৃত জন্মদাতা?
সময় এক নির্মম বিচারক। একটা সময় আসে, যখন এক মা চুরি করে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়। একটা সময় আসে, যখন তরুণটি ফাঁসি ঝোলে চাকরি না পেয়ে। একটা সময় আসে, যখন বৃদ্ধ পিতা নিজ সন্তানকে হত্যা করে অবহেলায় পচে যাওয়া মন নিয়ে। এই সময় কি কারও বানানো না?এই সময় কি রাষ্ট্র, সমাজ আর মানুষের সম্মিলিত ব্যর্থতা না?
সমাজ ও কাঠামো: চোখে পরা অথচ অদৃশ্য এক জেলখানা
সমাজ যখন গরিবের প্রেমকে ‘অপরাধ’ আর ধনীর ধর্ষণকে ‘ভুল’ বলে, তখন প্রশ্ন উঠে—এ সমাজ কি ন্যায়বান, না অপরাধপ্রেমী? যখন বিচার হয় টাকা আর তদবিরের মাপে, তখন আদালতের দরজা থেকে বিবেক হারিয়ে যায়।
তখনই তো কেউ বেছে নেয় বোমার রাস্তা, গুলির পথ।
তাহলে সত্যিকারের অপরাধী কে?
প্রথমত, অপরাধী কেউ একজন নয় — সে এক সম্মিলিত সৃষ্টি: রাষ্ট্রের অবহেলা,সমাজের অবিচার, মানবিকতা হারানো সময়, নিরাশার অভিশাপ।যে যুবক ছিনতাই করেছে, তাকে জিজ্ঞেস করুন— কেন? যে নারী পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়েছে, তাকে বলুন— কোথা থেকে শুরু?শুধু সাজা নয়, দরকার শ্রবণক্ষমতা, সহমর্মিতা আর কাঠামোগত সংশোধন।
উপসংহার: আয়নার সামনে দাঁড়ান, প্রশ্ন করুন—
“আমি কি এই অপরাধজগতের একজন সক্রিয় নির্মাতা?” “আমি কি কেবল নীরব দর্শক, না একজন পরিবর্তন-আনয়নকারী?”আজ যদি একজন কিশোর জেলে যায়, আগামীকাল হয়তো আপনার সন্তানও সেই ‘সময়’-এর শিকার হবে। তাই—অপরাধী খুঁজতে হলে আয়নার দিকে তাকান। সমাধান খুঁজতে হলে মাটির কান্না শুনুন। নির্বাচনের দিন, আদালতের দিনে, কিংবা কোনো গরিব মায়ের চোখের সামনে— আপনার ভূমিকা নির্ধারণ করুন।
সমাপ্তি নয়, শুরু:
এই প্রশ্ন আমাদের প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতে হবে— “অপরাধী কে?” কারণ উত্তর খোঁজাটাই সভ্যতার সূচনা।
বিশেষ অনুরোধ: যদি এই লেখাটি আপনার হৃদয়ে আঘাত করে, তাহলে সেটি শুধু কষ্ট নয়, পরিবর্তনের ডাকও বয়ে আনুক। পরিবর্তন শুরু হোক… আপনি থেকে।
এম.এ. এ. বাদশাহ্ আলমগীর
Advocate
The Subordinate Courts of Bangladesh
Associated with Practice at the High Court
Legal Advisor, Apradhchokh24.com
Email: badshah.alamgir08@gmail.com