ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৩ জুলাই, ২০২৫ ১৫:০২ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৬৭৬ বার
একটি মুহূর্তের গর্জন, অনন্তকালের শোক
একটি প্রশিক্ষণ বিমান আকাশে ওড়ে, যেমনটা প্রতিদিনই করে। কিন্তু সেদিন সেটা আর ফিরে আসে না। ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা উত্তরা—আকাশ থেকে আগুন ছিটকে পড়ে, ঘর ভেঙে যায়, মানুষ আহত হয়। কেউ চিরতরে নিথর, কেউ আতঙ্কগ্রস্ত। প্রশ্ন জাগে—এটা কি নিছক দুর্ঘটনা? নাকি রাষ্ট্রীয় অবহেলার অনিবার্য পরিণতি? ঘটনার পর রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ‘তদন্ত চলছে’ বলেই দায় সারে। কিন্তু কী সত্যিই দায় শেষ হয়ে যায় তথাকথিত তদন্তে? না কি রাষ্ট্রের এই নীরবতা একটি কাঠগড়ায় দাঁড় করায় পুরো ব্যবস্থাকে?
সংবিধান ও রাষ্ট্রের দায়: “জীবনের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের কর্তব্য”
বাংলাদেশ সংবিধান বলছে—
অনুচ্ছেদ ১৫(ক): “নাগরিকদের মৌলিক প্রয়োজনসমূহ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।”
অনুচ্ছেদ ৩২: “কোনো ব্যক্তিকে তার জীবন বা ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, আইনের বিধান ব্যতীত।”
অনুচ্ছেদ ১৮(১): “রাষ্ট্র জনগণের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবার উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।” বসতিপূর্ণ এলাকার উপর দিয়ে প্রশিক্ষণ বিমান চালানো কি এই সংবিধানের পরিপন্থী নয়?
২. আইন কী বলে—জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কাঠামো
বাংলাদেশি আইন:
The Civil Aviation Act, 2017
Aircraft (Investigation of Accidents and Incidents) Rules, 2019 – ধারা ৪, ৭ ও ১৩ অনুসারে, নিরপেক্ষ তদন্ত বাধ্যতামূলক
Air Navigation Rules, 2022 – জনবসতিতে ফ্লাইট চালানোর আগে ঝুঁকি বিশ্লেষণ (Risk Analysis) বাধ্যতামূলক
আন্তর্জাতিক আইন:
Chicago Convention (Annex 13): দুর্ঘটনায় স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত বাধ্যতামূলক
Montreal Convention, 1999:
ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণে অধিকার
রাষ্ট্র বা সংস্থা অবহেলাজনিত হলে দায় এড়াতে পারে না
ICAO Guidelines: জনবসতিতে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট “discouraged unless properly risk-managed”
বাংলাদেশ ICAO-এর সদস্য। ফলে এই আইনের বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য।
পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা: আস্থা যখন শূন্যে পড়ে যায়
বিষয় তথ্য
২০০৩–২০২৪ বাংলাদেশে অন্তত ১৩টি বড় বিমান দুর্ঘটনা
ইউএস-বাংলা ২১১ ২০১৮ সালে কাঠমান্ডুতে ৫১ জন নিহত
ICAO USOAP ২০২৩ বাংলাদেশের সেফটি স্কোর ৬১.5% – বৈশ্বিক গড় (৬৭%) থেকে নিচে
তদন্ত বিলম্ব অধিকাংশ ঘটনায় তদন্তে বিলম্ব, ক্ষতিপূরণ আসে দেরিতে
বিশেষজ্ঞ মতামত
ব্যারিস্টার তানজিম আহমেদ: “Tort law অনুযায়ী, রাষ্ট্র ক্ষতিপূরণে বাধ্য; Sovereign Immunity প্রযোজ্য নয়।”
ড. মাহমুদ হাসান (উড্ডয়ন বিশ্লেষক): “সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তদন্ত নয়, স্বাধীন কমিশন গঠন আবশ্যক।”
ড. ফারহানা হক (আইন বিশেষজ্ঞ):“এই দুর্ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। Right to Life রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে ব্যর্থ।”
ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্য: রাষ্ট্রের নৈতিক উত্তরদায়িত্ব:
“যে একটি প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করে” – সূরা আল-মায়েদা (৫:৩২)
“রাষ্ট্র মানে শুধু পতাকা নয়—আস্থার প্রতীক।” – হুমায়ূন আহমেদ
“রাষ্ট্র নিজের নীরবতায় যদি মৃত থাকে, তাহলে সে জীবন্তও নয়।” – আলবেয়ার কামু
“The State is not God. It is only a trustee.” – Mahatma Gandhi
এখানে প্রশ্ন রাষ্ট্রের নৈতিকতা নিয়েও। শুধু তদন্ত নয়, জবাবদিহি, ন্যায়বিচার, এবং মানবিকতা রাষ্ট্রের অঙ্গীকার হোক।
রাষ্ট্রের দায়: আইনি দৃষ্টিকোণ : দায় তিনভাবে বিশ্লেষণযোগ্য:
নিয়ন্ত্রক ব্যর্থতা: জনবসতিতে ঝুঁকিপূর্ণ ফ্লাইটের অনুমতি
প্রতিরোধে অবহেলা: সঠিক রুট প্ল্যানিং, প্রযুক্তিগত রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি
তদন্তের স্বচ্ছতার অভাব: সেনা বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট পক্ষ নিজে তদন্ত করায় পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কা
দায়মুক্তির সীমাবদ্ধতা:
বাংলাদেশে Sovereign Immunity থাকলেও, Obiter dicta (ন্যায়বিচার প্রথা অনুযায়ী) অনুযায়ী যদি রাষ্ট্রীয় অবহেলা প্রমাণিত হয়, তাহলে ক্ষতিপূরণ আদায়ের মামলা করা যায়।
Rudal Shah v. State of Bihar (AIR 1983 SC 1086) – রাষ্ট্রকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়।
উত্তরার দুর্ঘটনায় রাষ্ট্রের ব্যর্থতা?
জনবসতিতে প্রশিক্ষণ ফ্লাইটের অনুমতি কোথা থেকে? দুর্ঘটনার Risk Assessment ছিল কি? তদন্ত কি নিরপেক্ষভাবে শুরু হয়েছে?ক্ষতিপূরণ কি নির্ধারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে?
করণীয় ও সুপারিশ
করণীয় উদ্দেশ্য
স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন স্বচ্ছতা নিশ্চিত
Flight Safety Audit ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা প্রতিরোধ
Civil-Military Oversight Board উভয় পক্ষের দায় নিরীক্ষা
Victim Compensation Law ক্ষতিপূরণে আইনি সুরক্ষা
জনবসতিতে প্রশিক্ষণ নিষিদ্ধ সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা
উপসংহার: এক বিমানের ধ্বংস মানে শুধু লোহা নয়, আস্থার চূর্ণবিচূর্ণতা
রাষ্ট্র যদি আকাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারে, তবে তার পতাকা আকাশে ওড়ানো সাজে না।এই লেখার কেন্দ্রবিন্দু একটাই:রাষ্ট্র মানে শুধু সরকারি অফিস নয়—রাষ্ট্র মানে দায়িত্ব, নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার।নাগরিকের জীবন যখন ঝুঁকিতে পড়ে, তখন রাষ্ট্রের নীরবতা দায়মুক্তি নয়—রাষ্ট্রের ব্যর্থতার স্বাক্ষর।
এম.এ. এ. বাদশাহ্ আলমগীর
Advocate
The Subordinate Courts of Bangladesh
Associated with Practice at the High Court
Legal Advisor, Apradhchokh24.com
Email: badshah.alamgir08@gmail.com