ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৬ জুলাই, ২০২৫ ১১:২৩ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৭০ বার
রাষ্ট্র কি অপরাধ সৃষ্টি করে? : “সব অপরাধ ব্যক্তি করে না, কিছু কিছু অপরাধ রাষ্ট্র করে—আর আমরা কেবল নীরব দর্শক।” — নাজিম হিকমত, তুর্কি কবি
জন্ম রাষ্ট্রের ছায়া এত দীর্ঘ কেন? : যে রাষ্ট্রনেয় জনগণের সুরক্ষার জন্য, যে তার নাগরিকদের দেয় ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি—সেই রাষ্ট্রই যখন হয়ে ওঠে শোষণের যন্ত্র, ভয় আর বৈষম্যের প্রতীক, তখন প্রশ্ন ওঠে: রাষ্ট্র কি শুধুই অপরাধ দমন করে, নাকি নিজেই অপরাধ সৃষ্টি করে? বাংলাদেশের মতো বাস্তবতায় এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় নীরব কণ্ঠে, বেদনার ছোঁয়ায়। কারণ— সরকার বদলালে বদলায় পুলিশ অফিসার, যেন তারা ‘জনতার নয়, ক্ষমতার চাকর’। সাধারণ নাগরিক খুনে গ্রেপ্তার হয়, রাজনৈতিক কর্মী প্রকাশ্যে হাঁটে। অস্ত্র নিয়ে মিছিল, আগুনের উল্লাস, অথচ কোথাও মামলা নেই। এই অবস্থায় আইন পরিণত হয় “নির্বাচিত অস্ত্রে”—ক্ষমতাহীনদের জন্য কঠোর, ক্ষমতাবানদের জন্য নীরব।
রাষ্ট্র যখন অপরাধকে আশ্রয় দেয় : ২০১৯ সালের কথা। কাকরাইলে এক ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে ওঠে ধর্ষণের অভিযোগ।পুলিশ ছয় মাস তদন্তপত্রই জমা দেয় না। অভিযোগকারী হাল ছেড়ে দেন।পরে জানা যায়, অভিযুক্ত ছিলেন স্থানীয় এক সাংসদের ঘনিষ্ঠ। প্রশ্ন করি—এই দায় কেবল ব্যক্তির? নাকি রাষ্ট্রই এখানে অপরাধীর রক্ষাকবচ?
রাষ্ট্রই কি অপরাধে সাহস যোগায়? :“যদি আইন সবার জন্য সমান না হয়, তবে অপরাধ করার সাহস রাষ্ট্রই দেয়।”-হান ফেই, প্রাচীন চীনা দার্শনিক। যখন মানুষ দেখে—নিপীড়ক অপরাধ করলে পুরস্কৃত হয়, আর সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয় ন্যায়বিচার থেকে, তখন বিশ্বাস হারিয়ে যায় শুধু রাষ্ট্রেই নয়, মানুষের ভিতরেও।
কীভাবে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ হতে পারে?: ১. বিচার বিভাগ ও পুলিশকে স্বাধীন করতে হবে, ২. রাজনৈতিক ছায়ায় আশ্রিত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, ৩. তদন্তে নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার অংশগ্রহণ জরুরি, ৪. আইন-প্রয়োগকারীদের প্রশিক্ষণে মানবতা ও নিরপেক্ষতা রাখা আবশ্যক
বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা:
ভারত : দিল্লি দাঙ্গায় প্রমাণিত উসকানিদাতারা দায়মুক্ত।
কখনও কখনও Supreme Court রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করে—তবে অনেক সময়েই দেরিতে।
যুক্তরাষ্ট্র : জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার পরও পুলিশ Qualified Immunity-র আড়ালে রক্ষা পায়।
বিচার হয় চাপের মুখে—কিন্তু কাঠামোগত বৈষম্য থেকেই যায়।
সাহিত্য কি রাষ্ট্রের অপরাধের পক্ষে না বিপক্ষে???:
Albert Camus – The Stranger : “আমার হাতে সামান্য সময় বাকি, সেটা আমি ঈশ্বরের জন্য নষ্ট করতে চাই না।”এখানে সমাজ বিচার করে মনোভাবকে, পরিস্থিতিকে নয়—সময়ের নির্মমতা এখানে স্পষ্ট।
Fyodor Dostoevsky – Crime and Punishment : রাসকোলনিকভ হত্যার মাধ্যমে ন্যায় আনতে চায়, কিন্তু পরে নিজেই নিজের কাছে অপরাধী হয়ে যায়। দারিদ্র্য, সময় ও মানসিক চাপ অপরাধের পেছনের গভীর কারণ।
চলচ্চিত্রের ভাষায় রাষ্ট্র ও অপরাধ:
Joker (2019, USA) : Arthur Fleck—একজন অচ্ছুৎ, বঞ্চিত মানুষ। রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে ঠেলে দেয় অপরাধের গভীর অন্ধকারে।
Court (2014, India) : একজন লোকগীতি শিল্পীর বিরুদ্ধে ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনা’র মামলা হয়।
বিচার হয় শিল্পীর, কিন্তু আসল অপরাধী—রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থা—রয়ে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
মাঠের অভিজ্ঞতা : “একটা হর্ন বাজলেই মানুষ মারামারির জন্য প্রস্তুত। এটা শুধু ট্রাফিক না, এটা সময়ের রাগ।”— ট্রাফিক সার্জেন্ট, ঢাকা। “আমি অপরাধী না। আমি শুধু চাই, আমার মা ঘুষ ছাড়া চিকিৎসা পাক।”-এক বিক্ষোভকারী, দক্ষিণ আফ্রিকা
বিচার ব্যবস্থায় বৈষম্য:
বাংলাদেশ : সেলিম, একজন রিকশাচালক—অজান্তে চোরাই মোবাইল কিনে ছয় মাস জেলে। কিন্তু চোরের খোঁজ নেই।
যুক্তরাষ্ট্র : Kalief Browder,অভিযোগ ছাড়া তিন বছর জেল খাটেন। মুক্তি পেয়েও বাঁচতে পারেননি-আত্মহত্যা করেন।
রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা:
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিমুক্ত করা
আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ
দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর করা
গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করা
যখন রাষ্ট্রই অপরাধ করে...:
১. পক্ষপাতী রাষ্ট্র কি ব্যক্তি অপরাধীর চেয়েও ভয়ংকর নয়?
২. রাজনীতি যদি অপরাধের ঢাল হয়, তাহলে মানুষ কোথায় যাবে?
৩. যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়ে পড়ে রাজনৈতিক অস্ত্র, তাহলে ন্যায় কোথায়?
৪. রাষ্ট্র যদি সত্য বলা অপরাধ বানিয়ে ফেলে, তবে আমরা কী স্বাধীন?
আমাদের সময় কি অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠেছে?: বেকারত্ব, সামাজিক বৈষম্য, বিচারহীনতা, দুর্নীতি—সব মিলিয়ে সময় যেন অপরাধে উৎসাহ জোগায়।
তাহলে প্রশ্ন হলো: আমরা কি কেবল ব্যক্তিকে দোষ দিচ্ছি, নাকি সময় ও কাঠামোকে দেখছি?
যা বলে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্ম: মনোবিজ্ঞান: Structural Violence: কাঠামোগত অবিচার অপরাধে উৎসাহ দেয়
Maslow’s Theory: মৌলিক চাহিদা পূরণ না হলে, নৈতিকতা টিকে না,
Paul Farmer: দারিদ্র্য আর অবহেলা অপরাধের মূল
সমাজবিজ্ঞান ও দর্শন: Rousseau: মানুষ জন্মগতভাবে ভালো, সমাজ তাকে ভেঙে দেয়, Amartya Sen: ন্যায়ের অনুপস্থিতি মানুষকে হতাশ করে,
Galtung: কাঠামোগত সহিংসতা সৃষ্টিকারী রাষ্ট্র অপরাধের কারণ,
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি : ইসলাম: ইমান দুর্বল হলে অপরাধ হয়, তবে সমাজের প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ।
খ্রিস্টান/হিন্দু ধর্ম: সময়ের কলুষতা মানুষের নৈতিকতা নষ্ট করে
পরিসংখ্যান যা বলে: বাংলাদেশ: TIB-এর মতে, বিচারখাতে দুর্নীতি অপরাধের উৎস
যুক্তরাষ্ট্র: গ্যাং কালচার ও বেকারত্ব
সুইডেন/কানাডা/জার্মানি: সামাজিক সেবা = কম অপরাধ, দক্ষিণ আফ্রিকা/ব্রাজিল: অবহেলা = বাড়তি অপরাধ
শেষ কথা : “অপরাধ কেবল ব্যক্তির ব্যর্থতা নয়—এটা সময়, কাঠামো আর রাষ্ট্রের সম্মিলিত ব্যর্থতা।”
তাই করণীয়:
সমাজে ন্যায় ও মানবিকতা ফিরিয়ে আনা
দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূরীকরণ
বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি
নৈতিকতা ও নাগরিক সচেতনতা গড়ে তোলা
নিজেকে প্রশ্ন করুন... সময় কি মানুষকে অপরাধে ঠেলে দিচ্ছে? আমরা কি কেবল দোষ চাপিয়ে দিচ্ছি, না কাঠামো বদলাতে চাচ্ছি? রাষ্ট্র অপরাধ করলে—তার বিচার করবে কে?ন্যায় কি এখন একটিমাত্র শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত?
এম.এ. এ. বাদশাহ্ আলমগীর
Advocate
The Subordinate Courts of Bangladesh
Associated with Practice at the High Court
Legal Advisor, Apradhchokh24.com
Badshah.alamgir08@gmail.com