ঢাকা, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

ভাষা জানে, বিবেক বোঝে, কিন্তু আইন শুনে না : অ্যাডভোকেট এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ২ অগাস্ট, ২০২৫ ১৬:৪৩ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩৫৪ বার


ভাষা জানে, বিবেক বোঝে, কিন্তু আইন শুনে না : অ্যাডভোকেট এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর

ভাষার আয়নায় বিবেক: যখন আইন হৃদয়কে বুঝতে ব্যর্থ হয়
আইন কেন যেন ‘কান’ হারিয়ে ফেলেছেঃ 
একজন মানুষ কাঁদে। আদালত নীরব থাকে। একজন মা চিৎকার করে বলেন, “বিচার চাই!”
বিচারক বলেন, “এই অনুরোধ আদালতের এখতিয়ারে পড়ে না।”
আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আইন শোনে না, কারণ তার কান নেই।
ভাষা—জানে,বিবেক—বোঝে, কিন্তু আইন—শুধু ধারা খোঁজে, ব্যাখ্যা চায়।

আইন ও ভাষার বিবর্তন: শব্দ যখন শরীর পেলোঃ
আইনের ভাষা একসময় ছিল মৌখিক—পঞ্চায়েতের রায়, সমাজপ্রধানের উচ্চারণ। পরে তা রূপ নেয় শিলালিপিতে, সংবিধানে, আদালতের রায়ে। ভাষার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আইনও হয়ে ওঠে কাঠামোবদ্ধ, প্রাতিষ্ঠানিক, এবং প্রায়শই সাধারণ মানুষের হৃদয়ের ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন।রবীন্দ্রনাথ একবার লিখেছিলেন: “শব্দ আছে, কিন্তু তা যদি প্রাণ না জাগায়—সে ভাষা মরুভূমির বাতাস।” আজকের আইনজীবীদের মুখে বা রায়পত্রে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ হয়তো নির্ভুল— তবুও হৃদয় বলে, “কিছু একটার অভাব বোধ করছি।” একটি শিশু যদি চুরি করে ক্ষুধায়, আইন পড়ে ধারা ৩৭৮; কিন্তু তার পেটের ক্ষুধা পড়ে না কেউ। ফ্রান্ৎস কাফকা "The Trial"-এ বলেছেন: “The law is inaccessible, hidden, and absurd.” আইন যেন একটা বন্ধ দরজা।
গালিব বলতেন: “হাজারও দুঃখ বলার মতো, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাই না— আর যদি পাইও, সে ভাষা আইন বোঝে না।”

বিবেক ও মানবিক ন্যায়ের দার্শনিক ব্যাখ্যাঃ
আইন ও ন্যায় কখনো কখনো সমার্থক নয়। আইন একসময় বলেছে: মানুষ দাস হতে পারে। নারী ভোট দিতে পারবে না। কেউ কালো হলে, সে ন্যায্যতা পাবে না। হান্না অ্যারেন্ট লিখেছেন:“The sad truth is that most evil is done by people who never make up their minds to be good or evil.” বিচারক হয়তো ধারা অনুযায়ী দণ্ড দেন, কিন্তু কখনো তা বিবেকের কান্না নয়। ইমানুয়েল কান্ট বলেছিলেন: “আমাকে সবচেয়ে বিস্মিত করে—উপরে তারা-ভরা আকাশ আর ভেতরে নৈতিক আইন।” এই নৈতিক আইনই বিবেক। আইন যদি কেবল বিধান হয়, তবে তা ভয় দেখায় কিন্তু অনুশোচনা, করুণা, ক্ষমা—সেগুলোর স্থান কোথায়?

প্রেম, নৈতিকতা ও ধর্মের ভূমিকা: আইন কি হৃদয়ের ভাষা বোঝে?ঃ
এক প্রেমিক মিথ্যা কথা বলে, কারণ সে প্রেমিকার জীবন বাঁচাতে চায়। আইন বলে—মিথ্যা অপরাধ। বিবেক বলে—এই মিথ্যাই তো সবচেয়ে সত্য। রবীন্দ্রনাথের “চণ্ডালিকা” মনে করিয়ে দেয়— “ধর্ম মানেই হৃদয়ের মুক্তি।”
ধর্ম বলে—ক্ষমা করো। প্রেম বলে—ভুল করলেও ভালোবাসো।
আইন বলে—“৩১(ক) ধারায় তুমি অপরাধী।”
গালিব লিখেছেন: “দিল হি তো হ্যায়, না সাঙ্গ ও খিশ্ত, দারদ সে ভর না আয়ে কিউঁ?”
হৃদয় তো পাথর নয়—সে কেন কাঁদবে না?
কোরআনে আছে— “ক্ষমা তাকওয়ার কাছাকাছি।” (সূরা বাকারা ২:২৩৭)
আইন যদি ন্যায়ের প্রতীক হয়, তাহলে সে কেবল প্রতিশোধ নয়, করুণা শেখাবেও।
সাহিত্য ও দর্শনের দৃষ্টিতে: ব্যথার আইনঃ
ডসটোয়েভস্কি “Crime and Punishment”–এ লিখেছেন:“Pain and suffering are always inevitable for a large intelligence and a deep heart.”
আইন এই ব্যথাকে বোঝে না। রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করেছেন:“ন্যায় বড়, না দয়া?”
Humphrey বলেছিলেন:“Laws are not enough unless they rest on the conscience of mankind.”
কাফকা তার চরিত্রকে এমন আইনি গোলকধাঁধায় ফেলেন, যেখান থেকে মুক্তি নেই।
বিচার হয়, কিন্তু বোঝা যায় না।আইন হয়ে ওঠে অজানা আতঙ্ক।

উপসংহার: যদি আইন হৃদয়ের ভাষা শিখতঃ
যখন আইন শুধু শাস্তির দিকে তাকায়, তখন সে মানবিকতা হারায়।
যখন ভাষা কেবল প্রচার করে, কিন্তু বোঝায় না—তখন সম্পর্ক ভেঙে পড়ে।
যখন বিবেক স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন সমাজ হয় নিষ্ঠুর।
আমরা নতুন আইন চাই না—
আমরা চাই শ্রবণশীল আইন,
যে শুনবে—শুধু যুক্তি নয়, কান্নাও।
যে দেখবে—শুধু অপরাধ নয়, মানুষকে।
যে বুঝবে—শুধু আইন নয়, প্রেম, বিবেক, ও হৃদয়।

শেষ পঙক্তি:
“ভাষা জানে, বিবেক বোঝে, কেবল আইন যেন এখন শুনতে শেখে হৃদয়ের ভাষা।”


   আরও সংবাদ